জুলাই আন্দোলনে শহীদদের একজন ১৮ বছর বয়সী তরুণ ইমাম হাসান মেহেদী। তার বয়স যখন ছয় বছর, তখন জন্মদাতা বাবা রিপন মিয়া ছোট্ট মেহেদী ও তার মা কুলসুম বেগমকে ফেলে রেখে চলে যান। বিয়ে করেন অন্য একজনকে। কিন্তু ছেলে শহীদ হওয়ার পর অনুদানের টাকা পেতে এখন মামলা ঠুকেছেন সাবেক স্ত্রী ও তার স্বজনদের বিরুদ্ধে। শহীদ মেহেদীর মা এখন আদালতে দৌড়াচ্ছেন মামলা মোকাবিলায়।
জানা গেছে, মেহেদী রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় কারখানায় কাজ করতেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত বছরের ১৯ জুলাই মহাখালী এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন তিনি। তাকে তার মা শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। পরে মোহাম্মদপুরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হলে তিনি মারা যান।
স্বজনরা জানান, মেহেদী মারা যাওয়ার পর শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে তার মা সরকারিভাবে ১০ লাখ টাকা অনুদান পান। অন্যান্য কয়েকটি সংস্থাও সহায়তায় এগিয়ে আসে। এই টাকাতেই দৃষ্টি পড়ে তার বাবার। যদিও মেহেদীর জাতীয় পরিচয়পত্রে বাবা হিসেবে তার সৎবাবা মোহামিন মিয়ার নাম উল্লেখ রয়েছে।
মেহেদীর এক স্বজন জানান, বাবা রিপন মিয়া যখন ছোট্ট মেহেদী ও তার মাকে ফেলে চলে যান, তখন সন্তান নিয়ে দিশেহারা মা আরেকজনকে বিয়ে করে ছেলেকে নিয়ে নতুন সংসার শুরু করেন। সেই থেকে সৎবাবা মোহামিন মিয়ার কাছেই বড় হন মেহেদী। আপন বাবা খোঁজ না নিলেও সৎবাবার কাছে আদর-স্নেহে বড় হয়ে ওঠেন। ২০২৩ সালে নিজের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) তৈরি করার সময় জন্মদাতা বাবার নাম না দিয়ে সৎবাবার নাম দেন তিনি।
পুলিশ ও আদালত সূত্র জানায়, ২০১২ সালে রিপন মিয়া তার স্ত্রী কুলসুম বেগমকে ডিভোর্স দেওয়ার পর আর কখনো খোঁজও নেননি। কিন্তু জুলাই আন্দোলনে মেহেদী শহীদ হওয়ার পর হঠাৎ পিতৃত্বের অনুভূতি জেগে ওঠে রিপন মিয়ার মনে। তিনি গত ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে প্রতারণার মামলা করেন। এতে মেহেদীর মা, সৎবাবাসহ কয়েক স্বজনকে আসামি করা হয়।
মামলায় অভিযোগ করা হয়, মেহেদীর মৃত্যুর পর প্রতারণা করে বাবার পরিচয়ে তার নাম বদল করে মোহামিন মিয়ার নাম দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সময় মেহেদীর ভরণপোষণের জন্যও তার কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে।
মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। যদিও তদন্ত সংস্থার তদন্তে বেরিয়ে আসে, মেহেদী জীবিত থাকাকালেই সৎবাবার নামে এনআইডি করে গেছেন। এত বছর খোঁজ না নিলেও, মেহেদী শহীদ হওয়ার পর পিতৃপরিচয় দিয়ে তার নামে অনুদানের টাকা হাতিয়ে নিতেই জন্মদাতা বাবা এই মামলা করেন।
পিবিআইর তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিহত মেহেদীর প্রাইমারি স্কুলের প্রত্যয়নপত্র, নাগরিকত্ব সনদপত্র এবং মৃত্যু সনদপত্রে জন্মদাতা বাবা রিপন মিয়ার নাম উল্লেখ আছে; কিন্তু এনআইডি কার্ড যাচাইয়ের ক্ষেত্রে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে সৎবাবার নাম লেখা।
মেহেদীর মা কুলসুম বেগম বলেন, ২০১২ সালে ছেলের বয়স যখন ৬ বছর, তখন আমাদের ছেড়ে তার বাবা চলে যান। এরপর থেকে কখনো আমাদের খোঁজখবর নেননি। এমনকি আন্দোলনে গুলি খেয়ে ছেলে যখন হাসপাতালে, সেটা জানার পরও দেখতে আসেননি। হাসপাতালের খরচ থেকে দাফন-কাফনের সব খরচ আমি এবং আমার স্বামী (মোহামিন মিয়া) দিয়েছি।
তিনি বলেন, রিপন মিয়া যখনই শুনেছেন অনুদানের টাকা পাওয়া যাবে, তখনই এসে আমাদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়েছেন। টাকার লোভেই তিনি এই মামলা করে আমাদের হয়রানি করছেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই উপরিদর্শক রবিউল ইসলাম বলেন, মামলার বিষয়টি অনেক সংবেদনশীল। তদন্তকালে প্রতিটি বিষয় খুব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, মৃত্যুর আগেই মেহেদী তার সৎবাবার নাম দিয়ে এনআইডি তৈরি করেছিলেন। এ ছাড়াও বাদী মামলায় টাকা আত্মসাতের যে বিষয়টি উল্লেখ করেছে সেটিরও সত্যতা পাওয়া যায়নি। মূলত অনুদানের টাকা না পেয়েই ক্ষিপ্ত হয়ে রিপন মিয়া এই মামলা করেন। মামলায় বিবাদীদের কোনো অপরাধ প্রমাণিত হয়নি। এ বিষয়ে আদালতে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।
সূত্রঃ কালবেলা
এ ইউ/
Discussion about this post