গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে বেইলী রোডের গ্রিন কোজি কটেজ বহুতল ভবনে অগ্নিবিভীষিকায় ৪৬ জন জীবন্ত দগ্ধ হওয়ার পর চেতনা ফিরেছে সরকারি সেবা সংস্থাসমূহের। বেইলী রোড়ের ট্র্যাজিডির পর বিভিন্ন রেস্তোরাঁর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে পুলিশ, রাজউক ও সিটি করপোরেশন। এখন প্রশ্ন উঠেছে, গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে যখন আটটি রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছিল, তখন কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর বেরিয়ে আসছে ভবন নির্মাণের বিভিন্ন অনিয়ম। আট তলা আবাসিক কাম বাণিজ্যিক ভবনে ছিল না রেস্তোরাঁ ব্যবসার অনুমোদন।
গ্যাস, পানি ও বিদ্যুত্-সংযোগ থাকার পরও ভবনের বিভিন্ন তলায় গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার হয়ে আসছিল। এখানে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ও পর্যাপ্ত সিঁড়ি না থাকায় এত লোকের প্রাণহানি। সে ভবনে অফিস ও আবাসিক হিসেবে ব্যবহূত হওয়ার কথা থাকলেও তা মানা হয়নি। একটি ভবনের কার্যক্রম পরিচালনা করতে আটটি সংস্থা থেকে অনুমোদন বা ছাড়পত্র নিতে হয়। অনেক ত্রুটি থাকার পরও নানাভাবে ম্যানেজ হয়ে সরকারি সংস্থাগুলো আটটি সংস্থা অনুমোদন দিয়েছে, বেইলী রোড়ের অভিশপ্ত ভবনটিতে। ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদন না নিয়ে কীভাবে ব্যবসা চলে? সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো দায় এড়াতে পারে না। সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে আবাসিক ভবনের নামে অনুমোদন নিয়ে বিভিন্ন স্থানে রেস্তোরাঁ গড়ে তোলা হচ্ছে। অবৈধভাবে অভিজাত এলাকায় একের পর এক গড়ে উঠেছে কাচে মোড়ানো দৃষ্টিনন্দন রেস্তোরাঁ। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের গাফিলতি, উদাসীনতা, দায়িত্বহীনতা এ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।
মূল নকশা অবজ্ঞা করে মালিকরা ইচ্ছেমতো ভবন গড়ে তুলেছে। এ আবাসিক ভবন, বাণিজ্যিক ভবন, হোটেল, রেস্তোরাঁর গ্যাস সিলিন্ডারগুলো ভবনের নিচে একটি নির্দিষ্ট স্থানে রেখে পাইপ লাইনের মাধ্যমে বিভিন্ন তলায় গ্যাস সরবরাহ, আগুনের সতর্ক করার যন্ত্র, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র, পানির রিজারভার এয়ার এপিট রাখা এবং বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড বিএনবিসিতে কোথায় কী ধরনের অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা থাকার বিধান থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। ফায়ার সার্ভিসও বলতে পারে না, কয়টি অনুমোদিত রেস্তোরাঁ রয়েছে।
যেসব নিয়ম মেনে রেস্তোরাঁ ব্যবসা পরিচালনার কথা, রাজধানীর তারকা হোটেল ব্যতীত আর কেউ ওসব নিয়মের তোয়াক্কা করে না। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ বলেছে, তারা কেবল অগ্নিদুর্ঘটনায় ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনায় নোটিশ দিতে পারে। তাদের সব ভবন তদারকির জন্য লোকবল নেই। স্থানভেদে সরকারি কমবেশি ১৩ প্রতিষ্ঠান দপ্তর থেকে ছাড়পত্র নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও মাত্র দু-তিনটি ছাড়পত্র নিয়েই দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে রেস্তোরাঁ ব্যবসা। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা বলেছেন, রেস্তোরাঁ ব্যবসার নিয়মকানুন এত জটিল করা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট দপ্তর সংস্থার কাছে গেলে গলদগর্ম হতে হয়। ঘাটে ঘাটে ঢালতে হয় টাকা। এসব জটিলতার কারণে ব্যবসায়ীরা অনুমতি নেওয়ার ক্ষেত্রে বিমুখ হয়েছেন।
কোনো ভবন অনুমোদন ও তৈরির সময় তদারকির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে নগর কর্তৃপক্ষের। ভবন ব্যবহারের জন্য অকুপেন্সি বা ব্যবহারের সনদ নেওয়ার বিধান থাকলেও ৯০ ভাগ মালিক তা নেয় না। জানা যায়, প্রতি বছর দেশে বাড়ছে অনুমোদনহীন ভবনের সংখ্যা। রাজউকের মতে, রাজধানীর ৬০ থেকে ৭০ ভাগ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ ও অনুমোদনহীন। রাজধানীসহ গুরুত্বপূর্ণ নগরীতে যত্রতত্র দাঁড়িয়ে আছে ছোট-বড় লাখ লাখ ভবন। অধিকাংশ সরকারি- বেসরকারি হাসপাতাল, মার্কেট, শপিংমল, বাণিজ্যিক ভবন, আবাসিক ভবন, শিল্প ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় রয়েছে। খবরে প্রকাশ—ঢাকা, চট্টগ্রামের ৫৪ শতাংশ ভবনই আগুনের ঝুঁকিতে। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ গুরুত্বপূর্ণ নগরীর বহুতল ভবনের মার্কেটের প্রবেশপথে বা আন্ডারগ্রাউন্ডে নানা দোকানপাট বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাখা হয়েছে গ্যাস সিলিন্ডারসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র ও ময়লা-আবর্জনা।
পার্কিংয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে দোকানপাট। এমন চিত্র অধিকাংশ মার্কেটে। ভবন নির্মাণে অনিয়ম ও অনুমোদন প্রদানে দুর্নীতি, ভবন মালিকের অবহেলা, অপ্রশস্ত চলাচলের সিঁড়ি, ছোট লিফট, নেই জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি, অগ্নিনির্বাপণের জন্য নিজস্ব কোনো ব্যবস্থা। ঢাকা, চট্টগ্রামের অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত অনেক এলাকার আবাসিক চরিত্র হারিয়েছে। এসব এলাকার আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। অধিকাংশ ভবনমালিক অনুমোদনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান করছেন। অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন ২০০৩ ও বিধিমালা ২০১৪ অনুযায়ী বহুতল ভবন নির্মাণে ফায়ার সার্ভিস থেকে অনাপত্তি ছাড়পত্র, ভবনের সম্মুখে সড়কের প্রশস্ততা, নকশা অনুসারে ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা, বিকল্প পথ, পানির সংস্থান, গাড়ি প্রবেশাধিকারের সুবিধা পর্যবেক্ষণ করে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র দেওয়ার বিধান থাকলেও প্রতিপালন হচ্ছে না।
২০২৩ সালে ৭ মার্চ ভয়াবহ বিস্ফোরণে রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে স্যানিটারি মার্কেটে বিস্ফোরণে ২৬ প্রাণ নিভে যায়। সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় বিস্ফোরণে ১৮ জনের মৃত্যু। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা চকবাজারের চুরিহাট্টা লেনের ৭৮ জনের পোড়া লাশের গন্ধ শেষ হতে না হতে ২৮ মার্চ ঢাকার বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হলে ২৬ জনের প্রাণহানি হয়। ২০১৭ সালের ৩ জুলাই গাজীপুরের ম্যালটিফ্যাবসে ১৩ জন। ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ট্রাম্পকো ফয়েলস কারখানার অগ্নিকাণ্ডে ৪১ জন। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর সাভারের আশুলিয়ায় তাজরীন গার্মেন্টসের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১১৫ জন।
২০১০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের গরিব এন্ড গরিব গার্মেন্টসে নিহত হন ২১ জন। একই বছরের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে স্মরণাতীতকালের অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হলে নিহত হয় ১২৪ জন। তার রেশ কাটতে না কাটতেই একই বছরের ১৪ ডিসেম্বর আশুলিয়ায় দ্যাটস ইট স্পোর্টস ওয়্যারে ২৯ জন। ২০০৬ সালে চট্টগ্রামের একটি পোশাক-শিল্পকারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ৬৫ জন। ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জে একটি পোশাককারখানায় ২০ জন শ্রমিক। ২০০৪ সালের মে ও ডিসেম্বর নরসিংদীতে দুটি গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ২১ জন শ্রমিক প্রাণ হারান। ২০০১ সালের আগস্ট ঢাকার মিরপুরের অগ্নিকাণ্ডে ২৪ জন শ্রমিক ও কাফরুলের ঘটনায় ২৬ জন নিহত হন। এভাবে গত ১৪ বছরে প্রায় ২৬৭ জনের মৃত্যু হলেও এসব ঘটনায় দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। ২০১০ সালে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি রাজধানীকে অগ্নিঝুঁকিমুক্ত করতে ১৭ সুপারিশ করলেও এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
কোনো একটি ঘটনা সংঘটিত হওয়ার আগে কেউ ঝুঁকি দেখে না। ঘটনা হওয়ার পর প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। যাদের দেখভাল করার দায়িত্ব, তাদের আইনের আওতায় আনতে না পারলে এসব ঘটনা ঘটতে থাকবে।
লেখক: অ্যাডভোকেট সালাহ্উদ্দিন আহমদ চৌধুরী লিপু, কলামিস্ট ও রাজনীতিক
সূত্র – ইত্তেফাক
এ এস/
Discussion about this post