ছুটে চলেছে দ্রব্যমূল্য। নিম্ন আয়ের মানুষদের বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা প্রায় অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে এবং যাচ্ছে। নিত্যপণ্যের বাজারে আগুন, এ আগুনে ঘরও পুড়ছে। বিনষ্ট হচ্ছে ঘরের শান্তি। ঘরের বাজেটে টান পড়েছে অনেকদিন থেকেই। বাজেট কাটছাঁট করতে করতে তলানিতে এসে পড়েছে। জীবনযাত্রার ব্যয় এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, নিদানকালের জন্য যার যেটুকু সঞ্চয় ছিল, তা-ও তলানিতে এসে ঠেকেছে। এরই মধ্যে আসছে রমজান।
সিয়াম সাধনার এ মাসটির জন্য ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকেন। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সেই যে বাজার গরম হয়েছে, সে গরম কিছুতেই কমছে না। নিম্ন আয়ের মানুষসহ মধ্যআয়ের মানুষ ও অবসরপ্রাপ্ত সত্ভাবে চলা চাকরিনির্ভর শ্রেণিও পড়েছে উভয় সংকটে। এরা জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করতে না পারছে টিসিবির ট্রাকের মাধ্যমে কমদামে পণ্য ক্রয় করতে, না পারছে বিকল্প কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে। দেশের এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি রোধের জন্য সরকার পেঁয়াজ, চিনি, ডিমসহ কিছু কিছু পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিলেও তা খুব একটা কাজে দিচ্ছে না।
দেশে ধারাবাহিকভাবে দারিদ্র্যের হার কমলেও বেড়েছে আয়বৈষম্য। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী দেশের ৩৭ শতাংশ মানুষ ঋণ করে সংসার চালায়। লাগামহীন দ্রব্যমূল্যসহ জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধিতে নিম্ন আয়ের মানুষ যে কতটা কষ্টে, কতটা যন্ত্রণায় দিনাতিপাত করছেন, তা শুধু ভুক্তভোগীরাই উপলব্ধি করছেন। নবগঠিত সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, অর্থনীতিতে বিদ্যমান সমস্যাগুলো বিশেষ করে উচ্চমূল্যস্ফীতি কমিয়ে দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে বারবার সতর্ক বার্তা দেওয়ার পরেও দ্রব্যমূল্য না কমে আরো বাড়ছে।
শুধু যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, তা নয়—গ্যাস, বিদ্যুত্, পানি, পরিবহন, চিকিত্সা ব্যয়, শিক্ষার উপকরণ ব্যয়, জীবন বাঁচানোর জন্য যে প্রয়োজনীয়, ওষুধ সে ওষুধের মূল্যবৃদ্ধিসহ সাবান, ডিটারজেন্ট, টুথ পাউডার, নারিকেলের তেলসহ এমন কোনো পণ্য বা সেবা নেই, যার মূল্য বৃদ্ধি পায়নি। সীমিত আর বাধা আয়ের মানুষের সংসার চলছে না কোনোভাবেই। আয় বাড়ানোর কোনো বিকল্প ব্যবস্থাও পাওয়া যাচ্ছে না। বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কেউ কিছুই করতে পারছে না।
গত ২২.০১.২৪ তারিখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কারসাজি করে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধিকারীদের বিরুদ্ধে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন কারসাজি করে দাম বাড়ালে তাদের বিরুদ্ধে তাত্ক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে। কেউ অবৈধভাবে এবং দুরভিসন্ধিমূলকভাবে অস্বাভাবিক মজুত করে দাম বাড়ালে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে সঙ্গে সঙ্গে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। কারসাজি করে দাম বাড়ালে জেলে পাঠানো হবে। কিন্ত তারা এতটাই বেপরোয়া যে, প্রধানমন্ত্রীর নিষেধাজ্ঞাকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছেন। জেল জুলুমের ভয় করছেন না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো সভা করে কঠোর ব্যবস্থাগ্রহণের কথা বললেও বাজারে এর কোনো প্রতিফলন নেই। রোজাকে সামনে রেখে গত ডিসেম্বর মাস থেকেই যে পণ্যগুলো রোজদারিদের জন্য অপরিহার্য, সেগুলোর মধ্যে ছয়টি পণ্যের মূল্য বাড়ানো হয়েছে।
এসব পণ্য হচ্ছে—ছোলা, ভোজ্য তেল, চিনি, পেঁয়াজ, মসুর ডাল ও খেজুর। বাকি সব পণ্য তো বাড়তি দামেই আছে তার পরও দফায় দফায় দাম বেড়েই চলেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কঠোরভাবে তদারকি না করলে রোজার মাসে স্বস্তির পরিবর্তে চাপে থাকবেন ভোক্তাসহ রোজদারিরা। ফলে ধারণা করা হচ্ছে, এবারও রমজানে বাড়তি দামে পণ্য কিনতে বাধ্য করবে অসাধু এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা। রমজানে যাতে খাদ্যপণ্যের ঘাটতি না হয়, সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক বাকিতে কয়েকটি খাদ্যপণ্য আমদানির বিশেষ সুযোগ দিয়েছে বলে পত্রিকান্তরে জানা যায়। যদিও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়কে ইতিমধ্যে নির্দেশনা দিয়েছেন। ক্যাব-এর সভাপতি গোলাম রহমান বলেছেন, সমন্বিত তদারকির কোনো ব্যবস্থা না থাকায় এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে। বাজার ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজিয়ে পণ্যমূল্যকে সহনীয় পর্যায়ে আনতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণের কথা শুধু মুখে বললে হবে না, এর জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
আমাদের দেশে সব সময় দেখা গেছে প্রতি বছর রমজান শুরুর আগে থেকেই বাজারে নিত্যপণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। এবারও তার কোনো ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হচ্ছে না। আশার কথা যে, এবারে নবগঠিত সরকারের মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রীরা দায়িত্ব গ্রহণের পরেই নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ে কঠোর বার্তা দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারেও অনিয়ম, দুর্নীতি, সিন্ডিকেট,মজুতদারির বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকার ঘোষণা দিয়েছে। বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী নিত্যপণ্যের বাজার সিন্ডিকেট দমনে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছেন। রেলপথ মন্ত্রীও দুর্নীতি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। কৃষিমন্ত্রী দায়িত্বগ্রহণের প্রথম দিনেই ফসলের উত্পাদন বৃদ্ধি এবং সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার কথা জানিয়েছেন।
ভূমিমন্ত্রীও একই কথা বলেছেন। এক্ষেত্রে তারা গণমাধ্যমের সহায়তা চেয়েছেন। কারণ গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে গণমাধ্যমগুলো দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে যেসব তথ্য তুলে ধরে, সেগুলো অনেক ক্ষেত্রে যথাযথ এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না বলে আমরা জানি। যদি এসব ক্ষেত্রে গণমাধ্যমপ্রদত্ত ও প্রকাশিত প্রতিবেদনের ওপর দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তাহলে গণমাধ্যমগুলো উত্সাহিত হবে এবং তাদের কার্যক্রম আরো জোরালো হবে বলে মনে করি। এ বিষয়টির দিকে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। আমাদের দেশে একটা রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে, আমরা দীর্ঘকাল ধরে দেখে আসছি, দেশে এক শ্রেণির অসাধু ব্যাবসায়ী রমজানকে কেন্দ্র করে মুনাফার পাহাড় গড়েন। বছর জুড়ে অপেক্ষায় থাকেন এই মাসটির জন্য। এরা নীতি-নৈতিকতা, মানবতা বা ধর্মীয় অনুভূতির ধার ধারেন না। এদের কাছে অর্থ সম্পদটাই সবকিছুর ঊর্ধ্বে। পবিত্র এই মাসে রোজাদাররা কতটা কষ্টে, কতটা যন্ত্রণায় তাদের প্রাত্যহিক জীবন নির্বাহ করবে, সেদিকে তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
অথচ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে পবিত্র এই সিয়াম সাধনার মাসে ব্যাবসায়ী সম্প্রদায় রোজাদারদের কথা ভেবে পণ্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার চেষ্টা করে। আর আমাদের দেশে ঠিক এর উলেটো চিত্র। আসন্ন পবিত্র সিয়াম সাধনার এ মাসে রোজদারিরা যাতে নির্বিঘ্নে সিয়াম সাধনা করতে পারে সেজন্য সরকারকে কঠোর হাতে বাজার নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির ব্যবস্থা নিতে হবে। নবগঠিত সরকার যে উদ্যোগ আর উদ্যম নিয়ে তাদের পথচলা শুরু করেছে সেটি যেন অব্যাহত থাকে,সাধারণ মানুষ যেন একটু সুখে শান্তিতে থাকতে পারে সেটাই আমাদের সকলের প্রত্যাশা।
লেখক: মনজু আরা বেগম, অথনীতি বিষয়ক বিশ্লেষক
সূত্র; দৈনিক ইত্তেফাক
এ এস/
Discussion about this post