ইসলামী ব্যাংক যেন এস আলমের টাকা বানানোর মেশিনে পরিণত হয়েছিল। ২০১৭ সালে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে ব্যাংকটি দখলের পর থেকেই নানা কৌশলে টাকা বের করতে থাকে চট্টগ্রামের এ বিতর্কিত ব্যবসায়ী। নামে-বেনামে ঋণ নেয়া হয়। ইসলামী ব্যাংক থেকেই টাকা বের করে আবার ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার কিনে রাতারাতি ব্যাংকটির প্রায় ৮২ শতাংশ মালিকানা বনে যায়। এভাবে নামে-বেনামে ও অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এক লাখ কোটি টাকার ওপরে অর্থ বের করে নেয়া হয়। শুধু তাই নয়, এস আলমের দখলকৃত অন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছেও আমানত রাখতে বাধ্য করা হয়। আবার ওই টাকা ব্যাংকগুলো থেকে ঋণের নামে বের করে নেয়া হয়। ইসলামী ব্যাংকের সর্বশেষ হিসেব মতে, এক সময়ে এস আলমের মালিকানায় থাকা পাঁচটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে সাত হাজার ২১৫ কোটি টাকা আমানত (প্লেসমেন্ট) রাখতে বাধ্য করে এস আলম। দীর্ঘ তিন চার বছর আগে এ অর্থ নেয়া হলেও এখনো ফেরত দেয়া হয়নি। বারবার তাগিদ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু ব্যাংকগুলোও এ অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। ইসলামী ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিভিন্ন ব্যাংকের নামে নেয়া অর্থগুলোও ফেরত পাওয়া গেলে রাতারাতি ইসলামী ব্যাংকের তারল্য সঙ্কট কেটে যাবে বলে তারা মনে করছেন। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ কামনা করছে ব্যাংকটি।
ইসলামী ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, সবচেয়ে বেশি পাওনা রয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের কাছে। এ ব্যাংকের কাছে ইসলামী ব্যাংকের পাওনা আছে দুই হাজার ৬৯০ কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংকের কাছে পাওনা রয়েছে দুই হাজার ৩৮০ কোটি টাকা, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের কাছে পাওনা রয়েছে ৯৬০ কোটি টাকা, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের কাছে পাওনা রয়েছে ৪৮৫ কোটি টাকা। অপর দিকে এস আলমের মালিকানাধীন সাবেক রিলায়েন্স পরে নাম পরিবর্তন করা আভিভা ফাইন্যান্সের কাছে পাওনা রয়েছে ৬৯০ কোটি টাকা।
ইসলামী ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানিয়েছে, প্রচলিত ব্যাংকগুলো সাধারণত টাকার সঙ্কট মেটাতে এক ব্যাংক আরেক ব্যাংকের কাছে টাকা ধার দেয়, যা ব্যাংকিং ভাষায় কলমানি মার্কেট বা আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার বলা হয়। সাধারণত যে ব্যাংকের কাছে উদ্বৃত্ত তহবিল থাকে ওই ব্যাংকই সঙ্কটে পরা ব্যাংকগুলোর কাছে টাকা ধার দেয়। এতে এক দিকে উদ্বৃত্ত অর্থ থাকা ব্যাংকগুলো যেমন টাকা ধার দিয়ে লাভবান হয়, তেমনি সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোও টাকা ধার নিয়ে তাদের সঙ্কট মেটাতে পারেন।
তদ্রূপ ইসলামী ব্যাংকগুলোও তাদের নিজেদের মধ্যে টাকা ধার দিয়ে থাকে যাকে ইসলামী ব্যাংকিং ভাষায় প্লেসমেন্ট বলে। জানা গেছে, ইসলামী ব্যাংক থেকে বিভিন্ন উপায়ে নামে- বেনামে এস আলম টাকা বের করে ক্ষান্ত হননি, তার দখলে থাকা আলোচ্য ব্যাংকগুলোতেও প্লেসমেন্ট দিতে বাধ্য করা হয়। ইসলামী ব্যাংকের যখন টাকার সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করেছে তখন দফায় দফায় চিঠি দিয়েও টাকা ফেরত পাচ্ছে না ব্যাংকটি। যেমন- ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের কাছে ১১ বার চিঠি দিয়েও টাকা ফেরত পায়নি ইসলামী ব্যাংক। প্রথমে ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর,
দ্বিতীয়বার গত বছরের ১৯ জানুয়ারি, এরপর ২৫ জানুয়ারি, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ৩০ মার্চ, ২৩ অক্টোবর, চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি, ২০ মার্চ, ১৮ এপ্রিল, ৩ জুলাই ও সর্বশেষ গত ৬ আগস্ট ব্যাংকটিকে চিঠি দেয়া হয়। কিন্তু ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।
তেমনিভাবে ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে দুই হাজার ৩৮০ কোটি টাকা ফেরত পেতে ১২ বার চিঠি দেয়া হয়, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের কাছ থেকে ৯৬০ কোটি টাকা ফেরত পেতে ৯ বার, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের কাছ থেকে ৪৮৫ কোটি টাকা ফেরত পেতে ১২ বার ও আভিভা ফাইন্যান্সের কাছ থেকে ৬৯০ কোটি টাকা ফেরত পেতে ১১ বার চিঠি দেয়া হয়। কিন্তু এসব টাকা ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না।
ইসলামী ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানিয়েছে, ইসলামী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জরিমানা গুনতে হচ্ছে, অথচ এ অর্থ ফেরত পাওয়া গেলে ইসলামী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি মিটিয়েও বরং উদ্বৃত্ত থাকবে। এ বিষয়ে প্রায়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন সাধারণ ব্যাংকাররা।
এস এম/
Discussion about this post