আল্লাহ মানবজাতিকে যত নিয়ামতরাজি দিয়েছেন, ভাষা তার মধ্যে অন্যতম। ভাষার এই মূল্যবান নিয়ামত আল্লাহ অন্য কোনো সৃষ্টিকে দেননি। ভাষার মাধ্যমে আমরা মনের ভাব প্রকাশ করতে পারি। পারস্পরিক সম্পর্ক, যোগাযোগ, তথ্যের আদান-প্রদান, দাওয়াহ ও তাবলিগ ভাষার মাধ্যমেই হয়ে থাকে। সুরা আর-রহমানের আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন : পরম দয়ালু (আল্লাহ), তিনিই শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন, তিনিই মানুষ সৃষ্টি করেছেন, তিনিই শিখিয়েছেন মনের কথা প্রকাশ করতে (সুরা আর-রহমান: ১-৪)।
বর্তমান পৃথিবীতে কয়েক হাজার ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে। অঞ্চলভেদে মানুষের চেহারায় যেমন ভিন্নতা আছে, আছে ভাষারও ভিন্নতা। এসবই আল্লাহর সৃষ্টিবৈচিত্র্যের অংশ। এ মর্মে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন : আর তার নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্যে অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে। (সুরা রোম:২২)। উপরের আয়াতগুলো থেকে আরও একটি বিষয়ের প্রমাণ পাওয়া যায়। সেটা হলো, ভাষার শিক্ষক স্বয়ং আল্লাহ। ভাষা না থাকলে আমাদের সীমাহীন বিপদের সম্মুখীন হতে হতো।
মানুষ যে ভাষায় কথা বলতে সবচেয়ে বেশি পারদর্শী, যে ভাষাটি সে তার পিতামাতা বা অভিভাবকের কাছ থেকে ছোটবেলায় শেখে, মোটাদাগে তাকেই মাতৃভাষা বলা হয়। ইসলাম মাতৃভাষাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। পড়াশোনা ও দাওয়াহর ময়দানে সাফল্য লাভের জন্য মাতৃভাষায় পারদর্শী হওয়ার বিকল্প নেই। আল্লাহ প্রত্যেক নবীকে তার দাওয়াতী অঞ্চলের ভাষা দিয়ে প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ বলেছেন : আমি প্রত্যেক রসুলকেই স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি, যেন জাতির সামনে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন (সুরা ইবরাহীম:৪)।
আমাদের নবি সা. শারীরিকভাবে আরবদের মাঝে আবির্ভূত হয়েছিলেন। যদিও তিনি কেয়ামত পর্যন্ত সকল দেশের সকল ভাষাভাষী মানুষের নবি; তবু প্রাথমিকভাবে যেহেতু তার দাওয়াতের অঞ্চল ছিল আরব, এ কারণে তার ওপর নাযিলকৃত কুরআনের ভাষা আরবি। শুধু তাই নয়, আল্লাহ তাকে আরবি ভাষায় অসামান্য বুৎপত্তি দিয়ে পৃথবীতে পাঠিয়েছিলেন। রসুল সা. নিজেই বলেছেন, আমি আরবদের মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধভাষী। এমনকি রসুলের সা. ওপর প্রথমদিকে আরবি ভাষার সাতটি উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষায় কুরআন নাযিল হয়েছিল। যেন আরবের প্রত্যেক অঞ্চলের উপভাষাভাষীরাও কুরআনের মর্ম আত্মস্থ করতে পারে।
আল্লাহর নবি মুসা আ. এর জিহ্বায় জড়তা ছিল। এ কারণে তাকে যখন নবুওয়াত দিয়ে ফেরাউনের কাছে পাঠানো হয়, তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেন- তার ভাই হারুনকেও আ. নবুওয়াত দিয়ে সঙ্গী করা হোক। কারণ, হারুন আ. এর মুখের ভাষা স্পষ্ট। বিষয়টি আল্লাহ চমৎকারভাবে কুরআনে ফুটিয়ে তুলেছেন : (মুসা), ফিরাউনের নিকট যাও, সে তো সীমালংঘন করেছে। মুসা বললেন, হে আমার প্রতিপালক, আমার বক্ষ প্রশস্ত করে দাও এবং আমার কর্ম সহজ করে দাও, আমার জিহ্বার জড়তা দূর করে দাও, যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে। আমার জন্যে ঠিক করে দাও একজন সাহায্যকারী, আমার স্বজনবর্গের মধ্য হতে আমার ভাই হারুনকে; তার মাধ্যমে আমার শক্তি সুদৃঢ় কর।
ভাষা আল্লাহর নিয়ামত
ভাষা আমাদের জন্য শুধু গুরুত্বপূর্ণই নয়, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে পাওয়া বিরাট নিয়ামতও বটে। এটা এতবড় এক নিয়ামত যে, আল্লাহ তাআলা নিজে ভাষার শিক্ষক। তিনি নিজ অনুগ্রহে আমাদেরকে ভাষা দান করেছেন।
সুরা বালাদে আল্লাহ তাআলা বান্দার প্রতি তার দানের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন: আর জিহ্বা ও ওষ্ঠ (সুরা বালাদ: ০৯)
অর্থাৎ তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন জিহ্বা এবং ঠোঁট, যার মাধ্যমে তোমরা কথা বলতে পারো, মনের ভাবকে প্রকাশ করতে পারো, এটা আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহসমূহের মধ্য থেকে একটা অনুগ্রহ।
ভাষার কুসংস্কার
আমাদের সমাজে এমন কোনো বিষয় হয়তো নেই, যার ব্যাপারে কুসংস্কার চালু নেই। ভাষার ব্যাপারেও আমাদের দেশে নানা ধরনের কুসংস্কার চালু আছে। আমাদের অনেকের ধারণা-ভাষার উত্তম-অধম আছে। অনেকে বলে- ইংরেজি খ্রিষ্টানদের ভাষা, বাংলা হিন্দুদের এবং আরবি মুসলমানের ভাষা। আসলেই কি ভাষার ধর্ম আছে? না, ভাষার কোনো ধর্ম নেই। তবে ধর্মীয় ভাষা আছে। যেহেতু ইসলামের উৎসভূমি আরব, যেহেতু কুরআন-হাদীসের ভাষা আরবি, অতএব ইসলামকে ভালোভাবে জানতে ও বুঝতে হলে অবশ্যই আরবি ভাষার ওপর দক্ষতা অর্জন করতে হবে। কিন্তু আরবির ওপর বুৎপত্তি অর্জনের অর্থ এই নয় যে বাংলাভাষাকে খাটো করতে হবে। নবিজিকে ভালোবাসা মানে বাবা-মাকে খাটো করা নয়। দুটোর ডাইমেনশন ভিন্ন। নবিজির প্রেমে আত্মহারা হয়েও বাবা-মাকে শতভাগ ভালোবাসা যায়। ভাষার ব্যাপারটাও তাই। আরবিকে গুরুত্ব দিয়েও বাংলাভাষাকে হৃদয়ে ধারণ করা যায়। সুতরাং, ইসলামের দৃষ্টিতে ভাষা হিসেবে আরবি অন্য দরকারি ভাষার মতোই। ইসলাম জানার প্রয়োজনে আমরা আরবি ভাষা জানব। অন্য ভাষার অনুবাদে কুরআন পড়ে সেই নির্দেশনা অনুযায়ী আমল করলে সেটাও আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
পৃথিবীতে যত ভাষা আছে, সবই আল্লাহর দান। আল্লাহর প্রিয় হওয়ার মানদণ্ড ভাষা নয়। ভাষা যদি আল্লাহর নৈকট্য লাভের মানদণ্ড হতো, আবু জেহেল হতো আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয়। কারণ, তার ভাষা ছিল আরবি। দেশ, বর্ণ, বংশ বা ভাষা নয়, বরং আল্লাহর প্রিয় হওয়ার মানদণ্ড তাকওয়া। আল্লাহ বলেছেন : তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তিই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকি। (সুরা হুজরাত:১৩)
এই সময়ের প্রেক্ষিতে সচেতন মুসলমানদের, বিশেষত দাইদের তিনটি ভাষার ওপর দখল থাকা জরুরি।
এক. বাংলা।
দুই. আরবি।
তিন. ইংরেজি।
স্বতঃস্ফূর্ত দাওয়াতি কাজের জন্য বাংলা জানার বিকল্প নেই। কারণ, এদেশে দাওয়াতি কাজ আপনাকে বাংলাতেই করতে হবে। আবার কুরআন-হাদীসের মূল নির্যাস থেকে জ্ঞানের সৌরভ গ্রহণ করতে হলে আপনাকে অবশ্যই শরণাপন্ন হতে হবে আরবির। সেই সাথে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যোগাযোগ, দাওয়াহ এবং ইংরেজি বইয়ের বিপুল ভাণ্ডার থেকে সমৃদ্ধ হতে হলে আপনাকে ইংরেজির ওপরও দখল থাকতে হবে। রাসুল সা. যায়েদ বিন রা.-কে দীনের প্রয়োজনে হিব্রু ভাষা শেখার নির্দেশ দেন এবং অল্প কয়েক দিনের মধ্যে তিনি তা আয়ত্ত করতে সক্ষম হন।
এই তিনটি ভাষা শুধু যে আপনার দীনের পথচলা সহজ করবে, তা কিন্তু নয়। আপনার জাগতিক প্রয়োজন ও উপার্জনের জন্যও ভাষা তিনটি সহযোগিতা করবে। এদেশের লাখ লাখ মানুষ মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করে। কিন্তু আরবি ও ইংরেজি না জানার কারণে তারা ভারত-পাকিস্তানের কর্মীদের থেকে অনেক পিছিয়ে থাকে।
ভাষারক্ষায় আত্মত্যাগকারীদের জন্য আমাদের করণীয়
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা রক্ষায় যারা জীবন দিয়েছেন তারা অনেক বড় সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। ইতিহাস তাদের যুগ যুগ ধরে স্মরণ করছে এবং করবে। এই মানুষগুলোর জন্য আমাদের কিছু করণীয় আছে।
এক. অবদান স্বীকার করা : মাতৃভাষার জন্য জীবন দেয়া পৃথিবীর ইতিহাসের বিরলতম ঘটনা। এর মাধ্যমে ওই মানুষগুলোর জুলুমের কাছে হার না মানার মনোভাব ফুটে ওঠে। আমাদের উচিত, মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকারের জন্য যারা জীবন দিয়েছেন, তাদের অবদানকে স্বীকার করা, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। রসুল সা. বলেছেন : যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না সে আল্লাহর প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না। (আবু দাউদ হা/৪৮১১)
দুই. দোয়া করা : মাতৃভাষার জন্য যেসব মুসলিম ভাই মারা গেছেন, তাদের পরকালীন মুক্তি এবং শহিদি মর্যাদার জন্য দোয়া করা আমাদের কর্তব্য। যারা নিজের প্রাণ, সম্পদ, সম্মান, পরিবার এবং বৈধ অধিকার রক্ষার জন্য নিহত হয়, হাদীসে তাদেরকে শহিদ বলা হয়েছে। শহিদ মিনারে ফুল দেয়া, বাদ্যবাজনা সহ গান গাওয়া, খালি পায়ে হাঁটা-এগুলো তাদের পরকালীন মুক্তির ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখে না। আমদের উচিত এমন কিছু করা, যার সুফল তারা কবরে বসে লাভ করবেন। যেমন : দোয়া করা। ঈসালে সাওয়াবের উদ্দেশ্যে দান করা। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের পক্ষ থেকে জনকল্যাণমূলক কাজ, যেমন: বৃক্ষরোপণ, কালভার্ট নির্মাণ, নলকূপ স্থাপন, কৃষকদের মাঝে বীজ ও সার বিতরণ ইত্যাদি করা। এগুলোর মাধ্যমে তারা উপকৃত হবেন।
মাতৃভাষা দিবসে আমাদের প্রতিজ্ঞা
এক. বিশুদ্ধ মাতৃভাষার চর্চা : মাতৃভাষা দিবসে আমাদের প্রতিজ্ঞা হবে-আমরা সুন্দর ও বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করব। অনেকে মায়ের ভাষায় কথা বলতে গিয়ে হীনম্মন্যতায় ভোগেন। এ জন্য অহেতুক ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেন। এটা এক ধরনের ভাষা-দূষণ। আবার প্রত্যেকটা ভাষারই আলাদা উচ্চারণরীতি আছে। আমরা ইংরেজির মতো করে বিকৃত বাংলা উচ্চারণ করব না। আমরা বাংলার সাথে ইংরেজির মিশ্রণ ঘটিয়ে জগাখিচুড়ি পাকাব না। আমরা যখন ইংরেজিতে কথা বলব, তখন পুরোটাই ইংরেজিতে বলব। আবার যখন বাংলায় বলব, তখন চেষ্টা করব পুরোটাই বাংলা বলতে।
দুই. বাংলাভাষা আমাদের সংস্কৃতির অংশ : অনেকগুলো উপাদান নিয়ে সংস্কৃতি গঠিত হয়। ভাষা তার মধ্যে অন্যতম। আমরা সর্বত্র মাতৃভাষার সংস্কৃতি চালু রাখব। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, আমার যে তারিখ অনুসরণ করে মাতৃভাষা উদযাপন করি, সেটাও বাংলা তারিখ নয়। খ্রিষ্টীয় তারিখ। বা যাকে আমরা প্রচলিত ভাষায় ইংরেজি তারিখ বলি।
তিন. ভাষাপ্রেম থাকবে হৃদয়ে : লৌকিকতা আমাদের অন্যতম প্রধান রোগ। আমরা সবকিছুই করি অন্যকে দেখানোর জন্য। মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের ক্ষেত্রেও আমরা লৌকিকতার রোগে আক্রান্ত। খুব কম মানুষই আমরা ভাষাপ্রেমকে হৃদয়ে ধারণ করি। অথচ উদযাপনের ক্ষেত্রে সকল জাতিকে পেছনে ফেলে দিই। উন্নত বিশ্বের মানুষের মধ্যে সবকিছু নিয়ে এমন বাড়াবাড়ি পর্যায়ের উদযাপন দেখবেন না। ভাষা বলুন কিংবা সংস্কৃতি, তারা নিজেদেরটাই আকড়ে ধরে রাখে। অন্যের ভাষা থেকে তারা সহজে একটা শব্দও ধার করে না। বিপরীতে অন্যের অন্ধ অনুকরণ ছাড়া আমাদের চলেই না।
চার. ভাষা হোক গালিমুক্ত : আমরা বাংলাভাষাভাষীরা কথার মধ্যে যে পরিমাণ গালিযুক্ত শব্দ উচ্চারণ করি, আমার জানা নেই অন্য কোনো ভাষার মানুষ এত পরিমাণ গালি ব্যবহার করে কি না। কথায় কথায় আপনি গালি দেন, একদিকে এতে যেমন আপনার কবিরা গোনাহ হচ্ছে, গালির মাধ্যমে আপনি আপনার ভাষাটাকেও দূষিত করছেন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হোক-আমরা আমাদের ভাষাকে গালিমুক্ত রাখব। গালি, ঝগড়া, পরনিন্দা ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা আল্লাহর নিয়ামত ভাষার অপব্যবহার করব না।
আল্লাহ আমাদেরকে মাতৃভাষার গুরুত্ব অনুধাবন করার এবং যাদের মাধ্যমে মাতৃভাষায় কথা বলার স্বাধীনতা পেলাম, ভুলত্রুটি ক্ষমা করে আল্লাহ তাদেরকে জান্নাতের উঁচু মাকাম দান করুন। আমিন।
লেখক : শায়খ আহমাদুল্লাহ; ইসলামি ব্যক্তিত্ব ও আলোচক।
সূত্র- চ্যানেল টোয়েন্টিফোর
এ এস/
Discussion about this post