এবারের ঈদে গাজার ফিলিস্তিনিরা আশা করেছিলেন একটু শান্তি আসবে তাদের জীবনে। মাসের পর মাস ধরে ইসরাইলের হামলায় যা কিছু তাদের অবিশিষ্ট ছিল তাই দিয়ে ঈদ উদযাপন করবেন। কিন্তু তা আর হলো না। পরিবর্তে, এই ঈদও কাটছে তাদের মৃত আপনজনদের কবর দিয়ে। কেউ কেউ হাতড়ে বেড়াচ্ছেন পুরোনো ঈদের স্মৃতি।
ঈদের আগের দিনও ইসরাইলের হামলা অব্যাহত থাকায় ফিলিস্তিনিদের অনেককেই সকালের ঈদের নামাজ পড়তে হয়েছে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে। অথবা কারও কারও তা পড়াই হয়নি। হয়ত প্রিয়জনকে কবর দেয়া, কবর খনন করার কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে।
মার্চের শুরু থেকে যখন ইসরাইল গাজায় আবার বোমাবর্ষণ শুরু করে এবং ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে, তখন থেকে আরও ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে উপত্যকাটি। নতুন করে ইসরাইলি সামরিক অভিযানে একদিনে বিমান হামলায় ১৮০টি শিশু নিহত হয়েছে। তাদের স্থল অভিযানে রাফাহ আবার ধ্বংস হয়েছে।
১৮ মার্চ থেকে ইসরাইলি বাহিনীর হাতে ৯০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
ঈদ উপলক্ষে শিশুরাও আর খেলনা বা উপহার চায়নি। পরিবর্তে তারা তাদের মৃত আত্মীয়দের জন্য প্রার্থনা করেছে।
১১ বছর বয়সী আহমেদ হামদান মার্চ মাসে তার বাবাকে হারিয়েছে। ইসরাইলের ড্রোন হামলায় তার বাবা মারা গেছেন। আহমেদের কাছে এখন বাবা ছাড়া ঈদের কোনো মানে নেই।
আহমেদ বলে, ‘তিনিই আমাকে আমার ঈদের পোশাক কিনে দিয়েছিলেন। তার জন্যই আমার কাছে ঈদ আনন্দময় হত। এখন, বাবা ছাড়া আমার আর ঈদকে কিছুই মনে হচ্ছে না।’
আহমেদের মতো গাজার প্রায় প্রতি ঘরে ঘরে একই অবস্থা। যেখানে শোক সামাজিক কাঠামোর অংশ হয়ে উঠেছে। প্রত্যেকেই কাউকে না কাউকে হারিয়েছে।
উত্তরাঞ্চলীয় শহর জাবালিয়ায়, ৩৪ বছর বয়সী রানিম মুসা তার বাড়ির ধ্বংসস্তূপের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে বলেন, ‘যখন যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হলো, তখন আমি আবারও আশা করতে সাহস করেছিলাম যে জীবন হয়তো আবার যুদ্ধের আগের মতোই হবে। কিন্তু এর পরিবর্তে জীবন আরও খারাপ হয়ে গেছে। নতুন করে বিমান হামলায় আমরা ধ্বংস হয়েছি এবং আমার ছোট ভাই নিহত হয়েছে। এখন, ঈদ আমাদের হারানো সবকিছুর আরেকটি বেদনাদায়ক স্মৃতি।’
মার্চ মাসে চালানো ইসরাইলি আক্রমণের ভয়াবহ মূল্য দিতে হয়েছে গাজার ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের। পুরো এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। জ্বালানি ও খাদ্যের অভাব দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সাহায্যও খুব একটা আসছে না।
যুদ্ধবিরতির সময়টার মতো রাস্তাঘাট, চারপাশেও আর উৎসবের শব্দে মেতে ওঠে না। এখন সব নীরব, কেবল দূর থেকে ড্রোনের গর্জন আর শোকের আর্তনাদ শোনা যায়।
২৬ বছর বয়সী এসরা তারতুর। ইসরাইলি হামলায় তার বাড়ির একটা অংশ ধ্বংস হয়েছে। বলেন, ‘একসময় ঈদের অর্থ ছিল আনন্দ – নতুন পোশাক, মিষ্টি, পরিবারের সাথে প্রার্থনা। কিন্তু গাজা যুদ্ধের মধ্যে এটি আমাদের তৃতীয় ঈদ এবং উদযাপনের পরিবর্তে, আমি কেবল আশায় বুক বেঁধে আছি। একটি উন্নত জীবনের জন্য নয় – কেবল এমন একটি জীবনের জন্য যেখানে আমি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারি।’
মার্চের শুরু থেকে মানবিক সংকট আরও গভীর হয়েছে। খাবারের দাম বেড়ে গেছে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত শাকসবজি – যা একসময় খাদ্যের প্রধান উপাদান ছিল, এখন জ্বালানি সংকটের কারণে ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। বেকারিগুলো বন্ধ রয়েছে। পানি ক্রমশ দূষিত হয়ে পড়ছে।
রোববার (৩০ মার্চ) ঈদের সকালে গাজা শহরের ৪৩ বছর বয়সী মোহাম্মদ আল-কাফারনা, তার স্ত্রী এবং পাঁচ সন্তানের সাথে টিনজাত ফাভা বিন এবং হুমাসের একটি সাধারণ খাবার ভাগ করে খেয়েছেন।
আল-কাফারনা জানান, ইসরাইলের এই সর্বশেষ হামলা প্রায় সবকিছুই কেড়ে নিয়েছে। তার বন্ধুবান্ধব, তার জীবিকা এবং তার দুই ভাই- বেইত হানুনে ইসরাইলি বাহিনীর সর্বশেষ অভিযানের সময় কারাবন্দি হন।
কাফারনা বলেন, ‘এই ঈদ আমি পরিবারের সাথে কাটাতে পারব না। ইসরাইলি হামলায় নিহত বন্ধুদের কবর জিয়ারত করব।’
বলতে বলতে কাফারনার কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে আসে। ‘আমরা মসজিদে সকালের নামাজের পর একসাথে কত মজা করতাম। এখন, আমি একা নামাজ পড়ি,’ বলেন তিনি।
সূত্র: টিআরটি গ্লোবাল
এম এইচ/
Discussion about this post