পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো ৮ ফেব্রুয়ারি। এরই মধ্যে ১০ দিন কেটে গেল। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এ পর্যন্ত অর্ধেক সময় দেশটি সরাসরি জেনারেলদের দ্বারা শাসিত হয়েছে। যখন সেনাদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে ছিল না, তখনও তারা দূর থেকে প্রশাসনের ওপর অসামঞ্জস্যভাবে ভূমিকা রেখেছিল।
পাকিস্তানের সমস্যা হলো, দেশটির বেসামরিক সরকারের রাজত্ব যার হাতেই থাকুক; অভ্যন্তরীণ নীতি, রাজনৈতিক বিষয় ও ভূকৌশলগত গতিপথে সামরিক লোকদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। অতীতে সব সময় বেসামরিক সরকার এস্টাব্লিশমেন্টের সুনজর থেকে ছিটকে পড়েছিল। সেসব সরকারকে অনেকাংশেই নত হয়ে যেতে হয়েছিল।
সম্ভবত এরই ধারাবাহিকতায় নির্বাচন কমিশন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার আগেই পাকিস্তানের সেনাপ্রধান সৈয়দ অসিম মুনির স্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠার জন্য দল ও নেতাদের উদ্দেশে বিবৃতি দিয়েছেন। কোনো গণতান্ত্রিক দেশে সেনাবাহিনী প্রধানের এমন আচরণ বিরল ঘটনা।
২০১৮ ও ২০২৪ সালের দুটি সাধারণ নির্বাচনের একটি দিক খেয়াল করার মতো। অনেকে মনে করেন, ২০১৮ সালে সামরিক বাহিনীর প্রিয়ভাজন হয়ে ইমরান খান সাবেক ক্রিকেট স্টার থেকে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ হয়ে যান। ওই নির্বাচনের আগে ২০১৭ সালে, স্টিল ব্যবসায় জগতের টাইকুন থেকে প্রধানমন্ত্রী হওয়া নওয়াজ শরিফ সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে তাল মিলাতে না পেরে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বিতাড়িত হন। ২০২৪ সালের নির্বাচনে ঘটেছে এর উল্টো।
তবে যেভাবে অনাস্থা ভোটে ইমরান খান সংসদ থেকে বিতাড়িত হলেন, তারপর ২০২২ সালের এপ্রিলের পর থেকে যা ঘটে গেল, তার তুলনা পাকিস্তানের ইতিহাসে নেই। দেশটির জন্য বিশেষত এই মুহূর্ত ছিল উৎকণ্ঠার, যখন এস্টাব্লিশমেন্টের রাজনৈতিক অভিসন্ধি ভয়ানকভাবে কেঁচে যায়। অতএব বিস্ময়কর নয় যে, প্রথমবারের মতো এবার এস্টাব্লিশমেন্ট ও রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যকার সম্পর্কের ইতিহাস পাকিস্তানের রাজপথে লিখিত হচ্ছে ।
এটি বললে অত্যুক্তি হবে না, ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগের শেখ মুজিবুর রহমান যা করেছিলেন, পিটিআই এবার সে রকমই কিছু একটা অর্জন করেছে। ইমরান খান (কয়েদি নম্বর ৮০৪, ব্যারাক ৩) তাঁর গুগলি দিয়ে স্পষ্টত পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ও তাদের পছন্দের দলকে একেবারে আউট করে দিয়েছেন।
শেষ মুহূর্তে অলৌকিক কোনো কিছু না ঘটলে হয়তো সামনে পাকিস্তানে এস্টাব্লিশমেন্টের আশীর্বাদপুষ্ট পিএমএল-এনসহ ছয়টি দল (পিপিপি ও এমকিউএম) নড়বড়ে জোট সরকার গঠন করবে। তবে কাঁটাযুক্ত মুকুট পরা ও একটি দুর্বল, অস্থিতিশীল সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার পরিবর্তে নওয়াজ শরিফ তাঁর ছোট ভাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফকে সে জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করেছেন।
ঘটনাবলি যেমনটা তুলে ধরছে, পিপিপি হয়তো সরকারের সঙ্গে যোগ দেবে অথবা জোটের বাইরে থেকে, বিলাওয়াল ভুট্টো যেমনটা চাচ্ছেন, সমর্থন দিয়ে যাবে। এটা খুব স্পষ্ট, সরকারের সততা ও বৈধতা নিয়ে সন্দেহ ও প্রশ্ন তো আছেই। পাশাপাশি তারা টিকে থাকার জন্য সামরিক বাহিনীর ওপর নির্ভর করবে। সশস্ত্র বাহিনীই সরকারের মেয়াদ ও কর্মসূচি নির্ধারণ করে দেবে। মুদ্রাস্ফীতি একেবারেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। মুদ্রার মান দিন দিন খারাপ হচ্ছে, এশিয়ার মধ্যে যার অবস্থান সবচেয়ে জঘন্য। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আশঙ্কাজনক কম এবং আগের চেয়ে অনেক বেশি দ্রুতগতিতে হ্রাস পাচ্ছে।
নিঃসন্দেহে পাকিস্তানের এবারের সরকার হবে সবচেয়ে নড়বড়ে প্রশাসনগুলোর একটি। কেননা, দশকের পর দশক ধরে দেশটির সামরিক ও রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জরাজীর্ণ বাস্তবতায় এ ধরনের পরিস্থিতি আগে কখনও আসেনি। প্রধানত জাতিরাষ্ট্র ও গণতন্ত্রের দিক থেকে দেশটিতে জেনারেলদের শাসনের পরম্পরা পাকিস্তানের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করেছে। তারা লৌহবদ্ধ মুষ্টি দিয়ে স্বৈরশাসকদের মতো শাসন করে গেছে।
বেসামরিক সরকার সেনাবাহিনীর ইচ্ছায় আসে, কিছুকাল থাকে, আবার চলেও যায়। এটা বলার ভিত্তি এই যে, পাকিস্তানের ২৩ জন প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে কেউই দায়িত্বের পুরো সময় স্বপদে বহাল থাকতে পারেননি। তত্ত্বগতভাবে, ২০০৮ সাল থেকে পাকিস্তান বেসামরিক শাসনের অধীনে রয়েছে। কিন্তু সেনাবাহিনী সব সময় নিজেদের এখতিয়ারের বাইরে সেখানে হস্তক্ষেপ করেছে। কোনো সরকারপ্রধান এস্টাব্লিশমেন্টের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গেলে তিনি ক্ষমতা ও সরকার থেকেও বিতাড়িত হয়েছেন।
আশ্চর্যজনক নয়, সেনাদের এ অপরাজেয় অবস্থান প্রায়ই পাকিস্তানি রাজনীতিবিদের মধ্যে ‘ভয়ংকর’ প্রতিদ্বন্দ্বিতার সৃষ্টি করেছে। তবে এবারের নির্বাচনে এই সামরিক ও রাজনৈতিক বন্দোবস্ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
জাতি হিসেবে টিকে থাকতে এবং উন্নতি করতে হলে পাকিস্তানের অবশ্যই কার্যকর গণতন্ত্র লাগবে। দেশটির এমন একটা প্রশাসনিক কাঠামো দরকার, যেখানে সামরিক বাহিনী ব্যারাকে ফিরে যাবে। এ ছাড়া বিচার ব্যবস্থা ও সশস্ত্র বাহিনীর মতো জাতির বিভিন্ন খুঁটি অবশ্যই নিজেদের এখতিয়ারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু এই পদ্ধতি তখনই কাজ করবে যখন দেশটির প্রত্যেকেই অন্যের ভূমিকার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে।
লেখক; অখিলেশ্বর সাহাই: ভারতীয় বিশ্লেষক; ফার্স্টপোস্ট থেকে অনুবাদ করেছেন ইফতেখারুল ইসলাম
সূত্র – সমকাল
এ এস/
Discussion about this post