আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান এক দিনে তৈরি হয়নি। গত ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশের কূটনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে অর্জন আমরা লক্ষ করি, তার মাধ্যমে বর্তমানে বিশ্ব কূটনীতির মঞ্চে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রবিরোধ কিংবা ভারতের সঙ্গে সমুদ্রবিরোধ নিষ্পত্তি থেকে শুরু করে ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সমস্যা সমাধান, চীন ও জাপানের সঙ্গে ব্যাপক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব, জলবায়ু কূটনীতি থেকে শুরু করে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রদানসহ সবকিছুর সঙ্গেই বাংলাদেশের কূটনৈতিক সাফল্য জড়িয়ে আছে।
পাশাপাশি ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় বাংলাদেশের গুরুত্ব বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’ মূলমন্ত্রের মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ একটি ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষার’ কূটনৈতিক কাঠামো বাস্তবায়ন করছে। ফলে বাংলাদেশের কূটনীতি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছে। বাংলাদেশের কূটনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হচ্ছে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করা। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি তথা আন্তর্জাতিক সম্পর্কে একটি নতুন ইস্যু হচ্ছে ‘গণহত্যা কূটনীতি’। বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যাকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক কূটনীতি, অর্থাত্ বাংলাদেশের বৈশ্বিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা গত কয়েক বছর ধরে সামনে চলে এসেছে।
২০১৭ সালের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস ঘোষণার পর থেকে কূটনীতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। মানব ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ও ঘৃণ্য অপরাধ হচ্ছে গণহত্যা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে বাঙালির বিরুদ্ধে সংঘটিত হয় এক ভয়াবহ পরিকল্পিত গণহত্যা। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া সরকারের নীলনকশা অনুযায়ী গোপনে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আক্রমণ করা হয় মুক্তিকামী নিরস্ত্র, নিরীহ বাঙালি জনগণের ওপর। হায়েনাদের এই আক্রমণে আক্রান্ত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রায়েরবাজার, রাজারবাগ পুলিশ লাইনসহ ঢাকা নগরী ও সমগ্র বাংলাদেশ। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে বহিঃশক্তির যত আক্রমণের শিকার হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম আক্রমণটি হলো ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের সেই গণহত্যা।
গণহত্যা কূটনীতি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কূটনীতি সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে, কূটনীতি এমন একটি কার্যক্রম, যার মাধ্যমে একটি দেশ তার নিজের সীমানার বাইরের জগতের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে জাতীয় স্বার্থ অর্জন করে। কূটনীতির মূল বিষয় হচ্ছে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে জাতীয় স্বার্থ অর্জন, যার মাধ্যমে দেশগুলো তাদের সম্পর্ককে পরিচালিত করে। অর্থনীতি থেকে শুরু করে সংস্কৃতিসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন দেশ জাতীয় স্বার্থসহ আঞ্চলিক কিংবা আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। কূটনীতির মৌলিক যে ধারণা, তার নির্যাস থেকেই বাংলাদেশের গণহত্যা কূটনীতি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার বিষয়ে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ে রয়েছে অস্পষ্টতা ও অজ্ঞতা। এমনকি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ‘গৃহযুদ্ধ’ কিংবা ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ যুদ্ধ হিসেবেও আখ্যায়িত করে বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রাম, অবর্ণনীয় ত্যাগ ও হানাদার বাহিনীর পাশবিক নির্যাতনকে উপেক্ষা করা হয়। ফলে বৈশ্বিক ডিসকোর্সে (discourse) গণহত্যার বিষয়টি রয়েছে অনেকটা অন্ধকারে। এই পরিস্থিতিতে বাঙালি জাতির, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য ঐতিহাসিক ও আত্মপরিচয়ের অবস্থান থেকে এটি একটি বড় আঘাত।
এই অবস্থা পরিবর্তনের জন্য জাতীয়ভাবে যেমন নানামুখী পদক্ষেপ প্রয়োজন এবং কূটনীতিতে এ বিষয়টি ব্যাপকভাবে যুক্ত করতে হবে। এই গণহত্যাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপজীব্য হিসেবে ধারাবাহিকভাবে বিবেচনা করতে হবে এবং নিরাপত্তা, বিনিয়োগ কিংবা জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়ের ন্যায় গণহত্যাসংক্রান্ত নীতি ও নির্দেশনা তৈরি করতে হবে। এই নীতি ও নির্দেশনাসমূহ ক্রমাগত বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্কে প্রয়োগ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, গণহত্যা কূটনীতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে একটি অবধারিত ও অনুসরণীয় কার্যক্রম, যার মূল বিন্দু হচ্ছে গণহত্যার আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক স্বীকৃতি অর্জন।
বাংলাদেশের গণহত্যার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে দিনাজপুর, চাঁদপুর, বরিশাল, ঝালকাঠি, রংপুর কুষ্টিয়া, নওগাঁ ও নড়াইলসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপকভাবে গণহত্যার চিত্র দেখা যায়। তার বাইরেও বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে ব্যাপক গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, যেখানে একেকটি ঘটনা বসনিয়া হার্জেগোভিনার গণহত্যার চেয়েও ভয়াবহ। এর অন্যতম একটি উদাহরণ হচ্ছে খুলনার চুকনগর গণহত্যা। সিলেটের খাদিমনগর চা-বাগানে এক ভয়ংকর গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল। তার বাইরেও পাহাড়তলী গণহত্যা, লাল ব্রিজ গণহত্যা, জিঞ্জিরা গণহত্যা, বরুঙ্গা গণহত্যা, মোজাফফরাবাদ গণহত্যাসহ এরকম অসংখ্য গণহত্যা রয়েছে।
এই গণহত্যা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে উঠে এসেছে। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণমাধ্যমে বাংলাদেশের গণহত্যার বিভিন্ন বিবরণ আমরা দেখতে পাই। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম যেমন—দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, নিউ ইয়র্ক টাইমস ও দ্য গার্ডিয়ানের কথা উল্লেখ করা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহুল প্রচারিত ম্যাগাজিন যেমন নিউজ উইক, সেখানেও এই খবর এসেছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমেও বাংলাদেশের এই গণহত্যার বিস্তারিত বিবরণ ও প্রমাণ আমরা পাই। তার পরেও আমরা দেখতে পাই, এই গণহত্যার বিষয়টি দীর্ঘদিন অনেকটা আড়ালে ছিল।
এই গণহত্যার কূটনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ ১৯৭১-এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করতে পারে এবং সেটি অত্যন্ত জরুরিও বটে। ২০১৭ সালের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে দাবি উত্থাপন করার মাধ্যমে একদিকে যেমন গণহত্যা দিবসটিকে জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে, একইভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গণহত্যাকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য যে কূটনীতি প্রয়োজন, সেই কূটনীতির বিষয়ের ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে। ফলে গণহত্যার বিষয়টিকে কূটনীতিতে খুব জোড়ালোভাবে তুলে ধরা প্রয়োজন।
এ বিষয়ে সাফল্য অর্জনের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে এটি নিয়ে কাজ করতে হবে। যেমন—গণহত্যার যে প্রমাণসমূহ সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, এগুলো সংরক্ষণ করা প্রয়োজন এবং নতুন যেসব প্রমাণ, সেগুলোও সংগ্রহ করে একটি বড় ধরনের আর্কাইভ তৈরি করতে হবে। এখানে মনে রাখতে হবে যে এই গণহত্যার কূটনীতি বাস্তবায়নের জন্য গণহত্যা দিবস ব্যাপকভাবে ও তৃণমূল পর্যায়ে পালন করা জরুরি। বাংলাদেশে গণহত্যাবিষয়ক শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম আরো বেশি শক্তিশালী করা প্রয়োজন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে আমন্ত্রণ করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের গণহত্যার বিষয়ে ধারণা দিতে পারে। জাতীয় পর্যায়ে একটি কমিটি করে গণহত্যার বিষয়টি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আরো বেশি পরিচিত করানোর বিষয়েও ভাবতে হবে।
সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে একটি পরিষ্কার নীতিমালা এবং সেটি উপস্থাপনের জন্য একটি শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি তৈরি করাটা অপরিহার্য। বিশেষ করে কূটনীতির আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। যেমন—বাংলাদেশের জনকূটনীতিতে গণহত্যার ইতিহাস এবং ধারণার ব্যাপকভাবে প্রচার করা প্রয়োজন। বিশেষত বাংলাদেশের দূতাবাস এবং মিশনসমূহের সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করে স্থানীয় জনসাধারণ ও নাগরিক সমাজ থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়কে যুক্ত করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রসমূহ থেকে গণহত্যার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি অর্জনের জন্য দ্বিপাক্ষিক কূটনীতিকে পরিচালিত করা যেতে পারে। অনেক বিশ্বনেতা, রাজনীতিবিদ, কবি, গায়ক যারা মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন দিয়েছিলেন, তাদের সঙ্গে বা তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের এ বিষয়ে নিয়োজিত করা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ, বিশেষ করে ইউনেসকো, ইউনিসেফ—এ ধরনের প্রতিষ্ঠানসমূহ এ বিষয়ে আরো বেশি বক্তব্য প্রচার করতে পারে।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশের গণহত্যাবিষয়ক গবেষণা প্রকল্প বা চেয়ার প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। যেসব দেশ গণহত্যার ক্ষত বহন করে, তাদের সঙ্গে আরো বেশি যোগাযোগ বাড়ানো এবং তার মাধ্যমে একটি ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা ফোরাম’ প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। সেই ফোরামের মাধ্যমে বিশ্বের যেকোনো অঞ্চলে সংঘটিত গণহত্যার বিচার কার্যকর করা এবং সেটির মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা যেতে পারে।
নতুন পর্যায়ে বাংলাদেশের গণহত্যা কূটনীতি অত্যন্ত জরুরি। এটিকে বাস্তবায়নের জন্য ক্রমাগত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে এবং এটি শুধু জাতিসংঘের স্বীকৃতির মাধ্যমেই যে অর্জিত হবে তা নয়, এটি যেকোনো পর্যায়ে অর্জিত হতে পারে। বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতির মাধ্যমে, তাদের পার্লামেন্টে স্বীকৃতির মাধ্যমে, সেই সব দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, নাগরিক সমাজ, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এমনকি ব্যক্তি পর্যায়ে স্বীকৃতির মাধ্যমেও সেটি সম্ভব। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এই গণহত্যার কূটনীতির বিষয় এবং গণহত্যা সম্পর্কে বিশ্বের ভেতরে একটি পরিষ্কার ধারণা তৈরির জন্য বাংলাদেশকে আরো বেশি গবেষণা ও শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ডে গুরুত্ব বাড়াতে হবে। দেশের ভেতরে তরুণ সম্প্রদায় এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণহত্যার যে ব্যাপকতা ও ভয়াবহতা, সেটি তুলে ধরা প্রয়োজন।
কারণ যখন একটি জাতির সর্বস্তরে গণহত্যার ধারণা ও ভয়াবহতা অনুধাবন করবে, তখন সেই জাতির গণহত্যাকে বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করতে বাধ্য হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব, বাংলাদেশের এই গণহত্যাকে স্বীকৃতি প্রদান করা, যার মাধ্যমে আজকে গাজায় সংঘটিত গণহত্যা কিংবা আগামী দিন অন্য কোনো রাষ্ট্রে সংঘটিত গণহত্যাকে প্রতিরোধ করতে, সেটির বিরুদ্ধে মানুষের বিবেককে শানিত করতে সহায়তা করবে।
লেখক :ড. দেলোয়ার হোসেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক। অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র – ইত্তেফাক
এ এস/
Discussion about this post