ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজা উপত্যকার ৭৭ শতাংশ ভূখণ্ডের কার্যত নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বলে জানিয়েছে হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার গণমাধ্যম কার্যালয়। তুরস্কের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা আনাদোলু এজেন্সির প্রতিবেদনে রোববার এ তথ্য উঠে আসে। গাজার ভেতরে অভিযান চালিয়ে এবং বিমান হামলার মাধ্যমে একের পর এক এলাকা দখলে নিচ্ছে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (IDF)। এর ফলে স্থানীয় ফিলিস্তিনিরা নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে সীমিত এলাকায় আটকা পড়েছে, অনেকে ঘর হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে।
গাজার জনমানুষের জীবন এখন বিভীষিকাময়। খাবার, পানি, চিকিৎসা ও আশ্রয়ের তীব্র সংকটে দিন কাটাচ্ছে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি। তাদের অনেকেই অনাহারে ভুগছে। শিশুদের পুষ্টিহীনতা চরমে পৌঁছেছে, বহু মানুষ আক্রান্ত বিভিন্ন সংক্রামক রোগে। জাতিসংঘ ইতোমধ্যেই এটিকে “পূর্ণাঙ্গ মানবিক বিপর্যয়” হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
গাজার গণমাধ্যম কার্যালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘মাঠ পর্যায়ের তথ্য ও যাচাইকৃত বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী গাজার ৭৭ শতাংশ এলাকার কার্যত নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলেছে। এসব এলাকা থেকে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক চলে যেতে বাধ্য করা হয়েছে, কিংবা গুলি করে তাড়ানো হচ্ছে।’ এতে গাজার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে নিরীহ ফিলিস্তিনিরা নিজেদের বাড়িঘরে ফিরতে পারছে না।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সম্প্রতি এক ভিডিও ভাষণে স্পষ্ট করে বলেছেন, ইসরায়েল গাজার প্রতিটি ইঞ্চি নিয়ন্ত্রণে নিতে চায় এবং সেই লক্ষ্যেই সামরিক অভিযান অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, ‘গাজার প্রতিটি ইঞ্চি আমাদের দখলে নিতে হবে। আমরা লড়াই চালিয়ে যাব, সফল হতে হলে আমাদের এমনভাবে লড়তে হবে, যাতে কেউ আমাদের থামাতে না পারে।’
ইসরায়েলি দৈনিক ইসরায়েল হাইয়োম সূত্রে জানা গেছে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আগামী তিন মাসের মধ্যে গাজার ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ অংশের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে চায়। বর্তমানে যে ৭৭ শতাংশ এলাকার কথা বলা হচ্ছে, তা এই পরিকল্পনার বড় অংশ সফল হওয়ারই ইঙ্গিত।
গাজার বিভিন্ন অংশে বর্তমানে যেসব ফিলিস্তিনি বেঁচে আছেন, তারা অনেকে দক্ষিণে সীমাবদ্ধ ছোট একটি ভূখণ্ডে গাদাগাদি করে বসবাস করছেন। সেখানে নেই পর্যাপ্ত খাবার, পানীয় জল, স্বাস্থ্যসেবা বা আশ্রয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে বাধা দিচ্ছে ইসরায়েলি অবরোধ ও বিমান হামলা। ফলে, এই ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোয় রোগ ও অনাহার দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
গাজার গণমাধ্যম কার্যালয় ইসরায়েলের দখলদারিত্বের কৌশলকে ‘গণ বাস্তুচ্যুতি, জাতিগত নিধন, নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা ও জোরপূর্বক অবৈধ বসতি স্থাপন’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। তারা আরও বলেছে, ইসরায়েল এখন এমনভাবে গাজায় হামলা চালাচ্ছে, যেন পুরো জনপদ ধ্বংস করে দিয়ে সেখানে নিজেদের মতো করে একটি নতুন উপনিবেশ গড়ে তোলা যায়।
এই গণমাধ্যম কার্যালয় সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও ফ্রান্সকেও গাজায় ‘গণহত্যায় সহায়তা’ করার জন্য দায়ী করেছে। কার্যালয়ের ভাষ্য, ‘এই অপরাধমূলক গণহত্যার জন্য শুধু ইসরায়েল নয়, বরং যেসব দেশ তাদের অস্ত্র, অর্থ ও কূটনৈতিকভাবে সহায়তা করছে, তারাও পূর্ণমাত্রায় দায়ী।’
গত অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলি অভিযানের পর থেকে একমাত্র ছোট একটি যুদ্ধবিরতির সময় ছাড়া নিরবচ্ছিন্নভাবে বিমান ও স্থল হামলা চালিয়ে যাচ্ছে IDF। সর্বশেষ তথ্যে জানা গেছে, ইতোমধ্যে নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা ৫৩ হাজার ৯০০ ছাড়িয়েছে। এদের মধ্যে বিপুলসংখ্যকই নারী ও শিশু।
শনিবারও ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত ২৩ জন। দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস, উত্তরের জাবালিয়া ও মধ্য গাজার নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরে হামলায় এই হতাহতের ঘটনা ঘটে। নিহতদের মধ্যে স্থানীয় সাংবাদিক আশরাফ আবু নার মানও রয়েছেন।
একইসঙ্গে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ এখন বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েছে, যাদের বেশিরভাগই আশ্রয় নিয়েছে খোলা জায়গায় কিংবা ধ্বংসস্তুপের পাশে। তারা চরম দারিদ্র্য ও নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছে।
কাতার, মিসর ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির আলোচনা চললেও তাতে কার্যত কোনো অগ্রগতি নেই। ইসরায়েল স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা যুদ্ধ পুরোপুরি শেষ না করে কোনো আলোচনায় রাজি নয়। নেতানিয়াহুর সরকার ‘পূর্ণ সামরিক বিজয়’ না পাওয়া পর্যন্ত গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার বা অস্ত্রবিরতিতে সম্মত হবে না বলে জানিয়েছেন।
২০২৪ সালের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC) ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়ভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। এর বাইরে, হেগ-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (ICJ) দক্ষিণ আফ্রিকার দায়ের করা মামলায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়াও চলছে।
তবে এসব বিচার প্রক্রিয়া বা আন্তর্জাতিক চাপ কোনোভাবেই নেতানিয়াহু সরকারকে থামাতে পারেনি। বরং যুদ্ধের মাত্রা আরও বাড়িয়ে পূর্ণ দখলের কৌশলেই এগোচ্ছে ইসরায়েল।
গাজায় ইসরায়েলি দখল ও মানবিক বিপর্যয়ের এই চিত্র প্রতিদিন আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে। আন্তর্জাতিক মহলের নীরবতা ও দুর্বল হস্তক্ষেপের সুযোগে ইসরায়েল এখন গাজায় একপাক্ষিকভাবে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পথে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। লক্ষাধিক ফিলিস্তিনির জীবন আজ চরম সংকটের মুখে। এটি নিছক যুদ্ধ নয়, বরং ইতিহাসের এক নির্মমতম মানবিক বিপর্যয়ের অধ্যায়।
এম এইচ/
Discussion about this post