গার্মেন্টস শ্রমিক আন্দোলনে উসকানি দেওয়ার অভিযোগে গত ৯ সেপ্টেম্বর নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া থেকে ইশতিয়াক আহমেদ হৃদয় (২৪) নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করে কেন্দুয়া থানা পুলিশ। তিনি ছাত্রলীগের নেতা। সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত নর্দার্ন বিশ্ববিদ্যালয় শাখার শিক্ষা ও পাঠ্যক্রম বিষয়ক সম্পাদক। তার বাড়ি নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার আঠারবাড়ী এলাকায়। ঢাকায় ছাত্রলীগ করলেও নিজ এলাকায় তিনি ছাত্রদলের নেতা। কেন্দুয়া সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক। হৃদয় নেত্রকোনা জেলা বিএনপির সদস্য সচিব ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ড. রফিকুল ইসলাম হিলালীর অনুসারী। তার ফেসবুক পোস্টেও ছাত্রদল নেতার প্রমাণ মেলে। গত ৩১ আগস্ট ফেসবুক পোস্টে পদবি উল্লেখ করে তিনি লেখেন, ‘দেশ গড়েছেন শহীদ জিয়া, নেত্রী মোদের খালেদা জিয়া। আমার ভাইয়ের রক্ত, বৃথা যেতে দেব না।’
২৩ আগস্ট মোটরসাইকেল শোভাযাত্রার ছবিসহ পোস্ট দিয়ে রফিকুল ইসলাম হিলালীর প্রশংসা করেছেন। হৃদয়কে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এ বিষয়ে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। তারা জানিয়েছে, ‘পোশাক কারখানায় নাশকতার মাধ্যমে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির উসকানিদাতা ছাত্রলীগ নেতা ইশতিয়াক আহমেদ হৃদয়কে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ‘সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গার্মেন্টস শ্রমিকদের উদ্দেশে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে ভাইরাল হন ছাত্রলীগ নেতা ইশতিয়াক আহমেদ হৃদয়।
গ্রেপ্তার হওয়ার পরদিনই নেত্রকোনার আদালত থেকে জামিন পান হৃদয়। ওই দিনই তিনি মোটরসাইকেল শোভাযাত্রাসহ এলাকায় যান। স্থানীয় সাংবাদিকরা জানান, ‘হৃদয় ঢাকায় ছাত্রলীগের নেতা; কিন্তু কেন্দুয়ায় তিনি ছাত্রদলের পদধারী নেতা।
ড. রফিকুল ইসলাম হিলালীর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অনেক নেতাকর্মী আছে। হৃদয় ঢাকার ছাত্রলীগ কর্মী কি না, বিষয়টি জানা নেই।’
কেন্দুয়া থানার ওসি মিজানুর রহমান আকন্দ কালবেলাকে বলেন, রিমান্ড আবেদন থাকা সত্ত্বেও আদালত থেকে হৃদয় জামিন পেয়ে যায়। এজন্য তাকে বেশি জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারিনি। উসকানি দেওয়ার বিষয়ে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে বলেছে, ‘গার্মেন্টস শ্রমিকরা ঠিকমতো বেতন পায় না, তাই তাদের হয়ে বিভিন্ন দাবির বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছেন, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।’ ওসি আরও জানান, ‘কেন্দুয়া থানার মামলায় জামিন পাওয়ার তিন দিন পর আশুলিয়া থানার আরেকটি মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
আশুলিয়া থানার ওসি আবু বকর কালবেলাকে বলেন, ‘গার্মেন্টস শ্রমিকদের উসকানি দেওয়ার অভিযোগে আমরা ৫ জনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। এলাকাভিত্তিক আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে নিজেদের পক্ষে নিতে তারা শ্রমিকদের উসকানি দিয়েছে। আধিপত্য বিস্তারের মূলে রয়েছে ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, অবৈধ দখল ও চাঁদাবাজির মতো বিভিন্ন বিষয়।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আন্দোলনকারী গার্মেন্টেস শ্রমিকদের কোনো সমন্বিত দাবি নেই। একেক কারখানার শ্রমিকদের দাবির ফর্দ একেক রকম। তার পরও চলছে তুমুল আন্দোলন ও ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা। এর নেপথ্যে রয়েছে চাঁদাবাজি, ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, অবৈধ দখল ও এলাকাভিত্তিক আধিপত্য বিস্তারের মতো ঘটনা। শিল্প এলাকায় গার্মেন্টসে অস্থিরতার সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য পেয়েছে পুলিশ।
তবে গোয়েন্দা সূত্র বলছে, ‘স্থানীয় পর্যায়ের বিএনপি নেতারা এসব অস্থিরতার জন্য মূলত দায়ী। তারা একেকটি গার্মেন্টস কিংবা এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া হয়ে আছেন। কিছু শ্রমিককে নানা প্রলোভন দেখিয়ে আন্দোলনে ব্যবহার করছেন। শ্রমিকরা যেসব ইস্যু সামনে রেখে আন্দোলনে নামছে, সেগুলোও তৃতীয়পক্ষের সুবিধাভোগীদের তৈরি করা।’
আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল পুলিশ-১-এর এসপি মোহাম্মদ সারোয়ার আলম কালবেলাকে বলেন, আমরা মূলত কোনো কারখানায় বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে কাজ করি। কারা উসকানি দিচ্ছে, কী বিষয়ে—সেটা নিয়ে গোয়েন্দারা আলাদাভাবে কাজ করছে। আমরা গার্মেন্টস কারখানায় অস্থিরতা রোধে সড়কে টহল দিচ্ছি। আমাদের সঙ্গে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি ও র্যাব সদস্যরা কাজ করছে। এখন পরিস্থিতির অনেকটা উন্নতি হয়েছে। বিশৃঙ্খলা কমে এসেছে।’
গার্মেন্টসসহ শিল্পকারখানায় শ্রমিক আন্দোলন বিষয়ে কাজ করছে সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। একটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা অনুসন্ধানে জানতে পেরেছি স্থানীয় বিএনপি নেতারা গার্মেন্টসসহ শিল্পকারখানায় অস্থিরতার জন্য দায়ী। তারা গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানার ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করছেন। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীদের অনুসারী পুরোনো চাঁদাবাজরা এখন বিএনপি নেতাদের ছত্রছায়ায় থেকে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন। তারা নানা ইস্যুতে শ্রমিক অসন্তোষ তৈরি করছেন।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, দলীয় পদবি ব্যবহার করে ঝুট ও শ্রমিক পরিবহন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে গত ১ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহ দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও ভালুকা বিএনপির আহ্বায়ক ফখরুদ্দিন আহমেদ বাচ্চুকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, আন্দোলনরত শিল্প শ্রমিকদের পক্ষ থেকে এমন কিছু দাবি তোলা হয়েছে, যা আগে শোনা যায়নি। আশুলিয়ার নরসিংহপুরে শারমিন গ্রুপের পোশাক শ্রমিকরা দাবি করছে—‘কারখানায় নারী ও পুরুষ শ্রমিকের আনুপাতিক হার সমান হতে হবে।’ এমন অভিনব দাবি আর কখনো শোনা যায়নি।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) কোনাবাড়ী জোনের সহকারী কমিশনার সুবীর কুমার সাহা কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা কথা বলে দেখেছি শ্রমিকদের সুনির্দিষ্ট কোনো দাবি নেই। একেক কারখানার শ্রমিকরা একেক ধরনের দাবি তুলে শিল্প কারখানায় অস্থিরতা তৈরি করা হয়েছে। বিক্ষোভ ও আন্দোলনের সুযোগে বেশ কিছু কারখানায় ভাঙচুর ও লুটপাটের চেষ্টা হয়েছে।’
আশুলিয়ার শারমিন গ্রুপের কারখানার শ্রমিকরা কর্তৃপক্ষের কাছে ২০ দফা দাবি জানিয়েছে। সেসব দাবির মধ্যে রয়েছে, কোনো শ্রমিক মারা গেলে কোম্পানির দায়িত্বে গ্রামের বাড়িতে লাশ পাঠাতে হবে। চাকরিতে থাকা অবস্থায় কেউ অসুস্থ হলে তার চিকিৎসার খরচ কোম্পানিকে বহন করতে হবে। মাতৃত্বকালীন ছুটির টাকা আগেই দিতে হবে। নরসিংহপুরের নাসা গ্রুপের কারখানার শ্রমিকদের ১৫ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে ১০ শতাংশ হারে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি ও ঈদে ১২ দিন করে ছুটি। জিএবি লিমিটেডের শ্রমিকদের ১০ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে—কারখানার খাবারে সপ্তাহে দুই দিন গরুর মাংস, দুই দিন মুরগির মাংস এবং দুই দিন সবজির সঙ্গে ডিম দিতে হবে। দাবিতে আরও রয়েছে, জ্বর, মাথাব্যথা হলে চিকিৎসা ও ওষুধ দিয়ে এক দিনের ছুটি, বছরে একবার পিকনিক, কমপক্ষে ১০ বছরের চাকরির নিশ্চয়তা দিতে হবে ইত্যাদি।
হা-মীম গ্রুপের আশুলিয়ার জামগড়ায় নেক্সট কালেকশন কারখানার শ্রমিকরা ন্যূনতম ২৩ হাজার টাকা বেতনের দাবিতে গতকাল শনিবারও আন্দোলন করে। পরে কর্তৃপক্ষ কারখানাটি সাময়িক ছুটি ঘোষণা করে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস এবং শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি রফিকুল ইসলাম সুজন কালবেলাকে বলেন, গার্মেন্ট কারখানাগুলোতে অনেক সমস্যা আছে। এসব সমাধানের জন্য অনেক কারখানায় শ্রমিকরা আন্দোলন করছে। তবে বর্তমানে আন্দোলন ও বিশৃঙ্খলার মূল কারণ হলো ঝুট ব্যবসাসহ কারখানাকেন্দ্রিক বিভিন্ন ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার অপচেষ্টা। এখন এক গ্রুপকে হটিয়ে অন্য গ্রুপ কারখানার ঝুট কারবারসহ বিভিন্ন ব্যবসা দখল করতে চাইছে। যারা দখল-পাল্টা দখল করতে চাইছে, তাদের অনেকের রাজনৈতিক পদ-পদবিও আছে।’
কিছু কারখানায় নারী ও পুরুষ শ্রমিক সমান নিয়োগ করতে হবে—এই দাবি কেন জানতে চাইলে রফিকুল ইসলাম সুজন বলেন, সুয়েটার বা নিটিং কারখানায় আগে পুরুষ শ্রমিক বেশি কাজ করত। এসব কারখানায় ‘জ্যাকার্ড মেশিন’ বসানো হয়েছে। আগে ম্যানুয়াল মেশিন একজন পুরুষ শ্রমিক একটি মেশিন চালাত। এখন একজন শ্রমিক ১০টি মেশিন চালাতে পারে। ফলে পুরুষ শ্রমিকের সংখ্যা কমে গেছে। এসব বেকার পুরুষ শ্রমিককে কাজ দেওয়ার কথা বলে আন্দোলনে নামানো হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ‘বিগত সরকারের আমলে আমাদের মূল দাবি ছিল শ্রমিকদের রেশন প্রদান, বিভিন্ন ‘কালো আইন’ বাতিল, গণতান্ত্রিক শ্রম আইন প্রণয়ন করা। আমরা বরাবরই বলছি, কারখানায় প্রয়োজন কার্যকর ট্রেড ইউনিয়ন বা অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন করার স্বাধীনতা চাই। এখন অনেক কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন আছে; কিন্তু সেটা মালিক পক্ষ নিয়ন্ত্রিত। ফলে শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য দাবির কথাগুলো সরাসরি বলতে পারছে না। যেমন শ্রমিকদের টিফিন বিল, নাইট বিল, ওভারটাইম বিল বৃদ্ধির দাবি নিয়ে কারখানার ভেতরেই মালিকদের সঙ্গে ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা বসে সমাধান করতে পারতেন। কার্যকর ট্রেড ইউনিয়ন না থাকায় শ্রমিকরা রাজপথে নেমে অবরোধ-আন্দোলন করা হচ্ছে।’
ফেডারেশনের এক নেতা বলেন, ‘সরকার বা কারখানার মালিকরা শ্রমিকের ব্যাপারে কোনো চিন্তাভাবনা করেন না। তারা শুধু ফ্যাক্টরি বাঁচাও ফ্যাক্টরি বাঁচাও করেন। শ্রমিকদের নানা ধরনের হুমকি দেন। বিষয়টি পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছে।
আশুলিয়া এলাকায় কর্মরত একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ‘ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নিতে শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ায় অস্থিরতা সৃষ্টি করছে একটি চক্র। তাদের মূল নেতৃত্বে যারা আছেন তাদের অনেকেই বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের পদধারী নেতা। এ ছাড়া যারা বিগত সরকারের আমলে ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেছে, তারা বহিরাগতদের ভাড়া করে এনে পোশাক খাতে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। স্থানীয় বিএনপির অনেক নেতা তাদের শেল্টার দিচ্ছে।
সূত্রঃ কালবেলা
এ ইউ/
Discussion about this post