ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, প্রাচীনকালে আরব বিশ্ব ছিল নারী অধিকার, নারী স্বাধীনতা ও নারী ক্ষমতায়নের লীলাভূমি। আরবের বেদুইন পরিবার ও সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক। নারী শুধু পরিবার ও সমাজেই নয়, রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা হচ্ছে মিশরীয় সভ্যতা। আজ থেকে ৫ হাজার বছর আগে মিশরের শাসক হয়েছিলেন রানি মেরনেইথ (Mer Neith)। তিনি তার স্বামী রাজা Djet মারা গেলে মিশরের রানি বা শাসক হন ২৯২০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। জানামতে, তিনিই পৃথিবীর প্রথম নারী শাসক।
তারপর মিশরে যে নারী শাসক হন, তার নাম নেইথিক্রেট (Neithikret) ২১৪৮-২১৪৪ খ্রিষ্টপূর্ব। তার পরে সবেক নেফারু (Sobek Neferu) ১৮০৬-১৮০২ খ্রিষ্টপূর্ব। তারপর হ্যাটশেপসুত খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ১৪৫৮-এর মধ্যে ২১ বছর। তারপর মিশরের শাসক ছিলেন রানি নেফারতিতি ১৩৫৩-১৩৩৬ খ্রিষ্টপূর্ব।
শেবার রানি বিলকিস। তার রাজ্য ছিল দক্ষিণ আরব, ইয়েমেন ও ইথিওপিয়া। তিনি পরাক্রমশালী বাদশাহ সুলাইমান নবির সঙ্গে সাক্ষাত্ করেছিলেন এবং দুই জনের মধ্যে অনেক মূল্যবান উপঢৌকন বিনিময় হয়েছিল। সুলাইমান নবির শাসনকাল ছিল ৯৭০-৯৩০ খ্রিষ্টপূর্ব। পরাক্রমশালী শেবার রানির কথা তাওরাত, বাইবেল ও কুরআনে উল্লেখ আছে। মিশরের আরেক পরাক্রমশালী শাসক ছিলেন রানি ক্লিওপেট্রা (খ্রিষ্টপূর্ব ৫১ থেকে ৩০)। তিনি সমরকুশলী, বীর যোদ্ধা, ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। রানি জাবিবা ছিলেন উত্তর আরবের শাসক।
তার শাসনকাল ৭৩৮-৭৩৩ খ্রিষ্টপূর্ব। তিনি এসিরীয় রাজা তৃতীয় টিগরাথ পিলসারের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন এবং তার বশ্যতা স্বীকার করে নিজ রাজক্ষমতা অক্ষুণ্ন রাখেন। সিরিয়া-ট্রান্স জর্ডানের সঙ্গে মেসোপটেমিয়া ও ইয়েমেনের বাণিজ্যপথ ছিল উত্তর আরবের মধ্য দিয়ে। তিনি যুদ্ধবাজ এসিরীয় রাজাকে কর প্রদান করে বাণিজ্যপথ ও বাণিজ্যের ওপর নিজ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখেন।
রানি সামসি (৭৩৩-৭১৫ খ্রিষ্টপূর্ব) রানি জাবিবার পর উত্তর আরবের শাসকের পদ লাভ করেন। তিনি দামস্ক, তায়ের ও ইসরায়েলের রাজাদের সঙ্গে এসিরীয় রাজা তৃতীয় টিগলাথ পিলসারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগদান করেন। যুদ্ধে রানি সামসি পরাজিত হয়ে মরুভূমিতে পালিয়ে যান, তার অনেক লোকবল ক্ষয় হয়, অনেকে বন্দি হন, অনেক উট, ভেড়া, সুগন্ধি, মশলা এসিরীয় রাজার হস্তগত হয়। পরে তিনি এসিরীয় রাজার কাছে আত্মসমর্পণ করেন এবং কর প্রদানে রাজি হন। রাজা তৃতীয় টিগলাথ পিলসার রানি সামসিকে আরবের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ করেন।
রানি ইয়াতি (৬৯৫-৬৯০ খ্রিষ্টপূর্ব) ৬৯৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে বেদুঈন আরব গোত্রসমূহের শাসক হিসেবে আবির্ভূত হন। তার ভাই বাসকানু ছিলেন তার সেনাপতি। রানি ইয়াতির পর তিয়েলহুনু তিয়েলহুনু (৬৯০-৬৭৬ খ্রিষ্টপূর্ব) আরবের শাসক হন। তার সেনাপতি ছিলেন হাজেল। এসিরীয় রাজা সেন্নাচেরিব ৬৯১-৬৮৯ খ্রিষ্টপূর্বের মধ্যে আরব আক্রমণ করলে রানি তিয়েলহুনু আদুম্মাতু নগরের দিকে গভীর মরুভূমিতে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। পথে তিনি ধৃত হন এবং বহু মালামালসহ তাকে মেসোমেটিয়ার এসিরীয় রাজধানী নিনেভে নিয়ে যাওয়া হয়।
সেন্নাচেরিব নিজ পুত্র আরদা মিলুসু দ্বারা নিহত হলে তার আরেক পুত্র ইসারহাদ্দন ভাইয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়ী হন এবং এসিরীয় সিংহাসনে আরোহণ করেন। ইসারহাদ্দন এসিরিয়ার রাজা হয়ে আরবদের সঙ্গে শান্তি স্থাপন করেন এবং রানি তিয়েলহুনুকে সসম্মানে মুক্তি দেন। সঙ্গে আলিলাত, নুহায় এবং ওরোটাল্টের ঐশ্বরিক মূর্তি এবং রাজকুমারী তাবুয়াকে ফেরত দেন। তাবুয়া ছিল তিয়েলহুনুর কন্যা এবং উত্তরাধিকারী। সম্ভবত শিশুকন্যা তাবুয়াসহ তিয়েলহুনু বন্দি হন। শিশুটি সেন্নাচেরিবের রাজপ্রাসাদে বেড়ে ওঠেন। কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন, মেয়েটির পিতা হয়তো সেন্নাচেরিব অথবা সেন্নাচেরিবের পুত্র ইসারহাদ্দন। এসিরিয়ানদের মিত্র হিসেবে তাকে সিংহাসনে বসানো হয়।
রানি আদিয়া (৬৫০-৬৪৭ খ্রিষ্টপূর্ব) ছিলেন উয়েতের স্ত্রী। উয়েত আরব বাহিনীগুলোর একজন সেনাপতি ছিলেন। ৬৫০-৬৪৭ খ্রিষ্টপূর্ব সময়ের মধ্যে এসিরীয় রাজা আসুরবানিপালের বিরুদ্ধে আরব বাহিনীর যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে আরবরা পরাজিত হয় এবং আদিয়া আসুরবানিপালের হস্তে বন্দি হন।
নাকিয়া (৭২৮-৬৬৯ খ্রিষ্টপূর্ব) ছিলেন এসিরীয় রাজা সেন্নাচেরিবের স্ত্রী, রাজা দ্বিতীয় সারগনের পুত্রবধূ, রাজা ইসারহাদ্দনের মাতা এবং রাজা আসুরবানিপালের দাদি। তিনি জাকুতু নামেও পরিচিত ছিলেন। তাকে বলা হতো রানি মাতা। তার পুত্র ইসারহাদ্দুন যখন রাজা হন, তখন তিনি ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান করেন। তার জন্য ১৪ ধরনের অফিস ছিল। যেমন—খোজা, কোষাধ্যক্ষ, লেখক, প্রাসাদ সুপারিনটেনডেন্ট, গ্রাম ম্যানেজার, সেনা কমান্ডার, দেহরক্ষী, প্রহরী, রথচালক, রথের তৃতীয় ব্যক্তি, ডেপুটি মদ পরিবেশক, ঘাটের ডেপুটি চিফ, প্রধান ধোপা এবং প্রধান ময়রা। তিনি নিয়মিত ধর্মীয় মন্দিরে প্রচুর দান করতেন, রাজপ্রাসাদের ঘোড়ার পেছনে অনেক খরচ করতেন। তবে কোনো কোনো রানির দাপট একটু বেশি ছিল। তারা একটু বেশি ক্ষমতা দেখাতেন এবং একটু বেশি সুবিধা ভোগ করতেন।
তখন তাদের আরবের রানিদের সঙ্গে তুলনা করে বলা হতো, ‘Queen of the Arabs’. সাম্মুরামাত (৮৫০-৭৯৮ খ্রিষ্টপূর্ব) নামে আরেকজন রাজপত্নী ছিলেন মহাক্ষমতাধর। তিনি ছিলেন এসিরীয় রাজা পঞ্চম শামশি আদদের স্ত্রী এবং তৃতীয় আদদ নিরারির মাতা। পুত্র অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তিনি পুত্রের পক্ষে রাজক্ষমতা পরিচালনা করতেন। তিনি তার পুত্র আদদ নিরারির সঙ্গে ইউফ্রেটিস নদী অতিক্রম করে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।
পালমিরা সাম্রাজ্যের শাসক ছিলেন রানি জেনোবিয়া ২৬৭-২৭২ খ্রিষ্টাব্দ। ২৬৭ সালে তার স্বামী ওডেনাথাসের মৃত্যুর পর তিনি পালমিরার রানি হন। পালমিরা ছিল সমৃদ্ধ নগরী, রোমের করদরাজ্য, সিরীয় অঞ্চলে এর অবস্থান। তিনি ছিলেন নির্ভীক যোদ্ধা, বিচক্ষণ, সংস্কৃতিসেবী। তিনি এক বছরের মাথায় পালমিরাকে সাম্রাজ্যে পরিণত করেন।
জেনোবিয়া ছিলেন কষ্টসহিষ্ণু, কর্মতত্পর, শিকার এবং অশ্বারোহণে নিবেদিত। তিনি মাথায় হেলমেট পরে মূল্যবান পাথর দিয়ে সজ্জিত জ্বলজ্বল করা অশ্ব গাড়িতে চলাচল করতেন। তিনি তার মিশরীয় প্রতিপক্ষ, রানি ক্লিওপেট্রার সঙ্গে আত্মীয়তার দাবি করতেন, গ্রিক শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন এবং নিজে আরামাইক, গ্রিক ভাষায় কথা বলতেন এবং কিছু ল্যাটিন ভাষা ব্যবহার করতেন। তার রাজসভায় দার্শনিক লুঙ্গিনাস প্রধান বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা অলংকৃত করেছিলেন। রানি জেনোবিয়ার পর আরেক পরাক্রমশালী নারী শাসক হচ্ছেন রানি মাবিয়া (৩৭৫-৪২৫খ্রিষ্টাব্দ)।
তিনি ছিলেন আরব তানুখ গোত্রের নারী। তার স্বামী আল হাবারি/ হাওয়ারির (al-Hawari) মৃত্যুর পর ৩৭৫ সালে সিরিয়া ও আরব কনফেডারেশনের শাসক হন। তিনি ৫০ বছর দেশ শাসন করেন। তিনি গথদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রোম সম্রাট ভ্যালেনকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করেছিলেন।
লেখক: রেজাউল করিম, সহযোগী অধ্যাপক
সূত্র – ইত্তেফাক
এ এস/
Discussion about this post