অনাস্থা ভোটে হেরে গেছেন ফরাসি প্রধানমন্ত্রী মিশেল বার্নিয়ে। এতে তার সরকারেরও পতন হয়েছে। পদে বসার মাত্র তিন মাসের মাথায় অনাস্থায় হেরে ক্ষমতাচ্যুত হলেন বার্নিয়ে। শিগ্গিরই দেশটির প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেবেন তিনি। বৃহস্পতিবার বিবিসি জানিয়েছে, ১৯৬২ সালের পর এই প্রথম অনাস্থা প্রস্তাবে সরকারের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ঘটনা ঘটল দেশটিতে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি মন্ত্রীদের ভোট ছাড়াই বিতর্কিত বাজেট বিল পাশ করেন বার্নিয়ে। ওই বাজেটে ছয় হাজার কোটি ইউরো ঘাটতি কমানোর লক্ষ্যে কর বাড়ানো এবং ব্যয় কমানোর পরিকল্পনা করা হয়। এ বাজেটকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ অভিহিত করে বিরোধী দল ও বামপন্থি দলগুলো সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেয়। বিবিসি জানিয়েছে, বাজেটের ওপর পরিচালিত এক জরিপে ৬৭ শতাংশ মানুষ এর বিরোধিতা করেন। তারপরও সোমবার বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করে বাজেট বিলটি পাশ করেন বার্নিয়ে। যার ফলে সৃষ্ট বির্তকের জেরেই তার বিপক্ষে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে অনাস্থা ভোট হয়। বুধবার পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট পাশ করেন আইনপ্রণেতারা। ৫৭৭ সদস্যের নিম্নকক্ষে ৩৩১ জন আইনপ্রণেতা অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে ছিলেন। পার্লামেন্টের স্পিকার ইয়ায়েল ব্রাউন-পিভেট জানিয়েছেন, শিগ্গিরই বার্নিয়েকে প্রেসিডেন্টের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে পার্লামেন্ট বিলুপ্ত ঘোষণা করতে হবে। ফরাসি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর কাছে বার্নিয়ের ও তার সরকারকে এখন পদত্যাগ করতে হবে। এর মধ্য দিয়ে তার সংখ্যালঘু সরকার দেশ পরিচালনায় মাত্র তিন মাস মেয়াদ পূরণ করবে, যা হতে যাচ্ছে ফ্রান্সের পঞ্চম প্রজাতন্ত্রে ১৯৫৮ সালে শুরু হওয়া কোনো সরকারের সবচেয়ে সংক্ষিপ্ততম মেয়াদ। বৃহস্পতিবার তার পদত্যাগ করার কথা রয়েছে।
সেপ্টেম্বরে মিশেল বার্নিয়েকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেন প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ। ব্রেক্সিট বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রধান মধ্যস্থতাকারী ছিলেন ৭৩ বছর বয়সি এই রাজনীতিক। ফ্রান্স এবং ইইউ-এর বিভিন্ন পদে দীর্ঘসময় দায়িত্ব পালন করেছেন ডানপন্থি রিপাবলিকান (এলআর) দলের সদস্য বার্নিয়ে। নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্রেও কিছুটা তাড়াহুড়ো করতে হবে ম্যাক্রোঁকে। কারণ, সপ্তাহান্তে প্যারিসে নটরডেম ক্যাথেড্রালের উদ্বোধন আয়োজনে আসবেন নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফ্রান্সের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি জানান দিচ্ছে যে বার্নিয়ের জায়গায় নতুন যে-ই আসুক না কেন, একই সমস্যার মুখোমুখি হবেন এবং ব্যর্থ হবেন। সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবেন না তারা এবং সরকারি ব্যয় কমানোর নতুন উদ্যোগের গ্রহণযোগ্যতা পাবেন না। আরও অনাস্থা প্রস্তাব আসা এবং সরকারের পতন হওয়ার শঙ্কাও জানিয়েছেন তারা।
এদিকে ফ্রান্সের সরকারের এ পতন ইউরোপের রাজনীতির ওপর ফেলেছে উদ্বেগের ছায়া। ফ্রান্সের এ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা শুধু ফরাসি জনগণ নয় বরং গোটা বিশ্বের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশ তথা বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক সংকট গভীর হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিষেশজ্ঞরা। ঐতিহ্যগতভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ‘ইঞ্জিন’ হিসাবে পরিচিত ফ্রান্স ও জার্মানি। ফরাসি রাজনীতির এই পরিস্থিতি স্বাভাবিকভাবে ইইউ-এর কার্যক্ষমতায় গভীর প্রভাব ফেলবে। অন্যদিকে জার্মানির জোট সরকার ভেঙে আগামী ফেব্রুয়ারিতে দেশটিতে সাধারণ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এ দেশটিও অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে অস্থির অবস্থায় আছে। এ পরিস্থিতিতে উদ্বেগ বাড়ছে ইউক্রেনেও। চালিকাশক্তির এই নড়বড়ে অবস্থায় দীর্ঘ সময় ধরে রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়তে থাকা ইউক্রেনের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি ইইউ কতটা সময় ধরে রক্ষা করতে পারবে, তা এখন ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান বোঝাতে ইউক্রেনের পক্ষে অবিচল অবস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ইউরোপ।
অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রশাসনে আসার পর ইউরোপের অবস্থা আরও টালমাটাল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। শুরু থেকেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে মার্কিন অংশগ্রহণের বিপক্ষে ট্রাম্প। ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি এবং প্রতিরক্ষা ব্যয় নিয়ে অসন্তোষ রাজনৈতিক বাস্তবতায় রূপ নিতে পারে। ফ্রান্স ও জার্মানির বেহাল রাজনৈতিক অবস্থার মধ্যে ইইউ-এর ভার বহনের জন্য শক্ত অবস্থানে নেই কেউই। ইউরো জোনের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এবং ইউরোপের অন্যতম প্রধান সামরিক শক্তি ফ্রান্স। দেশটির বর্তমান বাজেট ঘাটতি ইইউ-এর মানদণ্ডকে অতিক্রম করছে। ইউরোপের বাকি অংশেও উদ্বেগ তৈরি করছে দেশটির সরকারি ঋণের উচ্চ হার। এ অবস্থায় ফ্রান্সের রাজনৈতিক অস্থিরতা সমাধানে প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করলেও পার্লামেন্টের অচলাবস্থার পরিবর্তন করতে পারবেন না।
আর এম/
Discussion about this post