নতুন বছর আর মাত্র তিন সপ্তাহ দূরে। এখন পর্যন্ত মাধ্যমিকের বই ছাপাখানাতেই পাঠাতে পারেনি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। প্রাথমিকের বই ছাপাসহ সংশ্লিষ্ট কাজ তদারকিতে ইন্সপেকশন কমিটি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনটি শ্রেণির বই ছাপার কাজও এগিয়ে চলছে। কিন্তু তারা মাধ্যমিকে ইন্সপেকশন কমিটি নিয়োগ দিচ্ছে না। তার পরিবর্তে বিকল্প হিসেবে সরকারি প্রতিষ্ঠানকে এই কাজ দিতে চায় এনসিটিবি। যদিও তা বাস্তবসম্মত নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে থাকলে ডিসেম্বরের মধ্যে মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বই ছাপার কাজ শুরু করতে পারবে এনসিটিবি। তবে কোনোভাবেই অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির বই এই সময়ের মধ্যে ছাপা শুরু করতে পারবে না। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালার (পিপিআর) শর্ত অনুযায়ী কাজ করতে গেলে বই ছাপার কাজ চলে যাবে এপ্রিলে।
এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, নভেম্বরের শেষদিকে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির বই ছাপার কাজ শুরু হয়েছে। এখনো প্রেসে যায়নি চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বই। এই দুই শ্রেণির বইয়ের নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড (নোয়া) দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির বইও যায়নি প্রেসে। আবার বিলম্বের কারণে ডিসেম্বরের শেষদিকে মাধ্যমিকের বই প্রেসে যাবে। টেন্ডারের শর্তানুযায়ী, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বই ছাপার কাজ শুরু করতে করতেই ডিসেম্বর মাস শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। এ ছাড়া প্রেসে পাঠানোর পরও প্রাথমিকের বইয়ে অন্তত তিনবার সংশোধনী দেওয়া হয়েছে। মাধ্যমিকেও একই অবস্থা হতে পারে। সেটিও ছাপার কাজে বিলম্বের অন্যতম কারণ হতে পারে।
এনসিটিবি কর্মকর্তারা বলেছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতি, পরিমার্জনে দেরি, ইন্সপেকশন এজেন্ট নিয়োগে গড়িমসিসহ বিভিন্ন কারণে বই ছাপার কাজে দেরি হচ্ছে। এনসিটিবির ধারণা ছিল, বছরের শুরুতে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের হাতে কিছু ভালো বই তুলে দেওয়া সম্ভব হবে। আর জানুয়ারির মধ্যে সব বই শিক্ষার্থীরা হাতে পাবে। তবে বাস্তবতা বলছে, সেটি সম্ভব হবে না। কারণ, মার্চ মাসের শুরু থেকেই রমজান শুরু হবে। তখন শ্রমিক পাওয়া যাবে না। পাওয়া গেলেও রোজার ব্যস্ততায় তারা ঠিকমতো কাজ করবেন না। আবার তাড়াহুড়ো করে বই বুঝে পেতে গেলে আবারও বাচ্চাদের হাতে নিম্নমানের বই উঠতে পারে।
এবার সব শ্রেণিতে ৪০ কোটির বেশি বই বিনামূল্যে বিতরণ করবে সরকার। নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হতে আর তিন সপ্তাহ বাকি থাকলেও এসব বইয়ের মধ্যে মাত্র ৫ কোটি বইয়ের ছাপা শুরু করতে পেরেছে এনসিটিবি। এখনো প্রায় ৩৫ কোটি বইয়ের ছাপার কাজই শুরু করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।
কোন শ্রেণির বই কোন অবস্থায় আছে: এনসিটিবির উৎপাদন শাখার তথ্যমতে, প্রাথমিকের প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির ৯৮ লটের মধ্যে ৭০ লটের বই ছাপার কাজ চলছে। বাকি লটগুলোর কাজও দ্রুত শেষ করতে চায় এনসিটিবি। এ ছাড়া চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বই প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে অনুমোদন শেষ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এসেছে। এ সপ্তাহে সেটি মন্ত্রণালয় থেকে এনসিটিবিতে যাবে। এরপর নোয়া দেওয়া হবে। তারপর প্রেসগুলো চুক্তি করবে। বিতরণ শাখার তথ্যমতে, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বইয়ের চুক্তির জন্য নোয়া দেওয়া হয়েছে গত ২৫ নভেম্বর। চুক্তির জন্য প্রেসগুলো ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় পাবে। অষ্টম শ্রেণির বই পারচেজ কমিটি অনুমোদন দিয়েছে গত ২৭ নভেম্বর। এখন পর্যন্ত সেটির কোনো রেজুলেশন এনসিটিবিতে আসেনি। তবে এই সপ্তাহে আসতে পারে। নবম-দশম এখনো অনেক পেছনে। দশমের টেন্ডার জমা হয়েছে ২৫ নভেম্বর। দশম শ্রেণির বইয়ের মূল্যায়ন হয়েছে। এখন সেটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যাবে। আর নবম শ্রেণির বইয়ের এখনো মূল্যায়ন চলছে।
কেন বই ছাপার কাজ দেরি হচ্ছে: এনসিটিবি ও প্রেস মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বই ছাপানোর কাজ শুরু করার জন্য সবার আগে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিতে হয়। বিজ্ঞপ্তির পর টেন্ডারে অংশ নেওয়ার জন্য ২৭-২৮ দিন সময় পেতেন প্রেস মালিকরা। এবার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ১০ দিন সময় দিয়েছে এনসিটিবি। টেন্ডার ওপেন হওয়ার পর মূল্যায়ন ও যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করে এনসিটিবি। এসব কমিটি সর্বোচ্চ ২১ দিনের মধ্যে মূল্যায়ন ও যাচাই-বাছাই করে। এরপর বিষয়টি যায় হোপ তথা এনসিটিবি চেয়ারম্যানের কাছে। চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরের পর সেটি চলে যায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। এরপর মন্ত্রণালয় যাচাই-বাছাই করে। সেখানে আরও ১০-১৫ দিন সময় লাগে। সেখান থেকে যায় পারচেজ কমিটিতে।
এই কমিটির সভা হয় সপ্তাহে এক দিন, মঙ্গলবার। কোনো কারণে এক সপ্তাহে সভায় দরপত্র না উঠলে সেটি পরের সপ্তাহে চলে যায়। সবকিছু ঠিক থাকলে পারচেজ কমিটিতে উঠলেই দরপত্র অনুমোদন পায়। এরপর সেটি সরকার প্রধানের দপ্তরে যায়। সেখানে আরও ১০-১৫ দিন সময় লাগে। সেখান থেকে পাস হয়ে এটি যায় এনসিটিবিতে। এরপর এনসিটিবি প্রেসগুলোকে নোয়া দেয়। নোয়া পাওয়ার পর ৭ দিনের মধ্যে এক্সেপটেন্স আর ১৪ দিনের মধ্যে পারফরম্যান্স গ্যারান্টি (পিজি) দিতে হয় প্রেসগুলোকে। সব মিলিয়ে নোয়ার পর চুক্তির জন্য ২৮ দিন সময় পান প্রেস মালিকরা। চুক্তির পর ছাপার কাজ শুরু হয়।
পিপিআরের শর্ত অনুযায়ী, প্রেসগুলো চুক্তির জন্য ২৮ দিন সময় পাবে। এরপর ৪০ দিনের মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে। যদিও আগে মাধ্যমিকের বই ছাপার কাজে ৭০ দিন সময় পেতেন প্রেস মালিকরা। তবে এবার সময় কমিয়ে এনেছে এনসিটিবি।
এনসিটিবি সূত্র জানিয়েছে, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বই ২৩ ডিসেম্বরের মধ্যে চুক্তি হবে। এরপর ফেব্রুয়ারির শুরুতে এই শ্রেণির বইয়ের কাজ শেষ হবে। দরপত্রের শর্তানুযায়ী, অষ্টম শ্রেণির বই প্রেসে যেতে সময় লাগবে আরও প্রায় দেড় মাস। আর বই ছাপাতে সময় লাগতে পারে সব মিলিয়ে প্রায় তিন মাস। সে হিসেবে মার্চ মাসে এই শ্রেণির বই ছাপার কাজ শেষ হতে পারে। দশম শ্রেণির বই প্রেসে যেতে সময় লাগবে আরও প্রায় দুই মাস। আর বই ছাপার কাজ শেষ হতে সাড়ে তিন মাসের বেশি সময় লেগে যেতে পারে। সে হিসাবে বই চলে যেতে পারে এপ্রিলে। অন্যদিকে, নবম শ্রেণির বই প্রেসে যেতে আড়াই মাস আর বই ছাপানোর কাজ শেষ হতে চার মাস সময় লাগতে পারে। সে হিসাবে এপ্রিলে শেষ হবে এই শ্রেণির ছাপার কাজও। তবে দশম শ্রেণির এক কোটি বই আর্মি প্রিন্টিং প্রেসকে দেওয়া হয়েছে। সে হিসাবে কিছুটা সময় সাশ্রয় হতে পারে। পিপিআর বা দরপত্রের শর্ত শিথিল করা হলে, প্রেসগুলো চুক্তিতে সময় কম নিলে, মন্ত্রণালয়-পারচেজ কমিটি ও প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে দরপত্র অনুমোদনে সময় কম লাগালে এই ছাপার কাজ আরও এগিয়ে আসতে পারে।
এ ছাড়া বই পরিমার্জনে বেশি সময় নিয়েছে এ-সংক্রান্ত কমিটি। এখনো কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, পরিমার্জনের বেশিরভাগ কাজ করেছেন রাখাল রাহা। সে কারণে দেরি হয়েছে। এর প্রভাব ছাপার কাজে পড়েছে। এ ছাড়া ইন্সপেকশন এজেন্ট এখনো নিয়োগ করেনি এনসিটিবি। সে কারণেও দেরি হচ্ছে।
একজন প্রেস মালিক বলেন, এনসিটিবি এবার নিম্নমানের কোনো বই নেবে না বলে আমাদের জানিয়েছে। আমরা সেটি মেনে নিয়েছি এবং সর্বোচ্চ ভালো মানের বই দিতে প্রস্তুত আছি; কিন্তু সে জন্য ঠিক সময়ে আমাদের কাজ দিতে হবে। সেটি এনসিটিবি করছে না। এর পেছনে এনসিটিবির চেয়ারম্যান, সচিবসহ কিছু কর্মকর্তা দায়ী। তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ে এতদিন দরপত্রের কাজগুলো করেছেন খ ম কবিরুল ইসলাম। তিনি সম্প্রতি কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব হয়ে গেছেন। নতুন যিনি আসবেন, তিনি কতটুকু পারবেন, সে প্রশ্নও রয়ে গেছে।
এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, মার্চ বা এপ্রিল মাসে বই যাওয়ার সুযোগ দেখছি না। প্রাথমিকের বই ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে চলে যাবে। ১০ জানুয়ারির মধ্যে মাধ্যমিকের বইও শিক্ষার্থীদের হাতে চলে যাবে। মাধ্যমিকের চার-পাঁচটি বই আমরা ডিসেম্বরের মধ্যে পেয়ে যাব। এ ছাড়া এনসিটিবির ওয়েবসাইটে ১ জানুয়ারি সব বই আপলোড করা হবে। যাতে শিক্ষার্থীদের শ্রেণি কার্যক্রম ব্যাহত না হয়। চ্যালেঞ্জের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, এবার বইয়ের সংখ্যা বেশি। আবার পরিমার্জনও করতে হয়েছে। রি-টেন্ডার করতে হয়েছে। সব মিলিয়ে খুবই চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। প্রিন্টাররা আন্তরিক হলে ঠিক সময়ে বই দেওয়া সম্ভব।
ইন্সপেকশন নিয়ে এনসিটিবির অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত: এনসিটিবি সূত্র জানায়, মাধ্যমিকের ইন্সপেকশনের জন্য এনসিটিবি প্রাক্কলিত দর দিয়েছিল ৭৫ লাখ টাকা। কিন্তু সর্বোচ্চ দর উঠেছে ৩২ লাখ টাকা। এ দর দিয়েছে ব্যুরো ভেরিটাস নামক একটি কোম্পানি। এ ছাড়া রয়েছে হাইটেক, ইনফিনিটি, ইনডিপেন্ডেন্ট, শেখ এবং ফিনিক্স। এদের মধ্যে সর্বনিম্ন ৩ লাখ ৯৯ হাজার দিয়েছে হাইটেক। সে কারণে এনসিটিবি ইন্সপেকশন এজেন্টকে কাজ না দিয়ে সরকারি সংস্থাকে কাজ দিতে চায়।
এনসিটিবি চেয়ারম্যান বলেন, ইন্সফেকশন এজেন্টের জন্য কাজ বন্ধ রাখা হবে না। আমরা বিকল্প প্রস্তাব মন্ত্রণালয়কে দেব। পিডিআইটা অন্তত বিএমটিএফকে (বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি) দিতে চাই। কয়েকদিনের মধ্যে তারা কাজ শুরু করতে পারবে। সায়েন্স ল্যাব, বিএসটিআই, বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ল্যাবে টেস্ট করে আমরা প্রেসকে কাজ দেব।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সায়েন্স ল্যাব ও বিএসটিআইতে কাগজের মান যাচাই করে ঠিক সময়ে বই দেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ, ১৫০ প্রতিষ্ঠানের কাগজ যাচাইয়ের মতো সক্ষমতা তাদের নেই। তা ছাড়া সময়ও লাগবে বেশি। তার ওপর নেই পূর্ব অভিজ্ঞতা। আবার এসব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কাজও রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাজের ইন্সপেকশন আরেকটি সরকারি প্রতিষ্ঠান করতে পারে না। এ ছাড়া সারা দেশে প্রেস রয়েছে। সব প্রেসে গিয়ে ইন্সপেকশন করার মতো লোকবল এই প্রতিষ্ঠানের নেই। সে কারণে দেরি হবে।
এনসিটিবির এক কর্মকর্তা বলেন, যাদের ইন্সপেকশনের কাজ দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তাদের অভিজ্ঞতা নেই। এত বেশিসংখ্যক প্রেসে গিয়ে প্রতিদিন রিপোর্ট পাঠিয়ে তারা কাজ করতে পারবে না। আবার সায়েন্স ল্যাব এত কম সময়ে এতবেশি কাগজ যাচাইয়ের চাপ নিতে পারবে না। সে জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনে রিটেন্ডার করা উচিত এনসিটিবির।
সূত্রঃ কালবেলা
এ ইউ/
Discussion about this post