বঙ্গোপসাগর বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তিস্থল। গত ২০০ বছরে বঙ্গোপসাগরে থেকে তৈরি ঘূর্ণিঝড় এর প্রভাবে প্রায় ২০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। মূলত বঙ্গোপসাগরের ত্রিভুজ আকৃতি এবং ভৌগলিক অবস্থানের কারণেই সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের সবচেয়ে বড় শিকারে পরিণত হয়ে আসছে বাংলাদেশ।
আপাতদৃষ্টিতে বঙ্গোপসাগর এক শান্ত সুনীল বিস্তীর্ণ জলরাশি হিসেবে মানুষের চোখে ধরা পড়লেও বিশ্বের ইতিহাসে যত ভয়ংকর সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হেনেছে, তার বেশিরভাগেরই উৎপত্তিস্থল এই সমুদ্র। জানুয়ারিতে এই বিস্তীর্ণ জলরাশি শান্ত সুনীল, কিন্তু গ্রীষ্মে যেন ফুঁসতে থাকা ঘোলা জলের সমুদ্র দানব।
‘ওয়েদার আন্ডারগ্রাউন্ড’ নামের একটি ওয়েবসাইটে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর ৩৬টি মৌসুমী ঘূর্ণিঝড়ের তালিকা রয়েছে। এই তালিকার ২৬টি ঘূর্ণিঝড়েরই উৎপত্তিস্থল বঙ্গোপসাগরে। এরই ধারাবাহিকতায় আরেকটি ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে আসছে উপকূলের দিকে।
বিশ্বের মোট মহাসাগরীয় অঞ্চলের মাত্র শূন্য দশমিক ছয় শতাংশ স্থান অধিকার করে আছে বঙ্গোপসাগর। কিন্তু এর তটরেখা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ সমুদ্র উপকূল সেখানে বাস করে প্রায় অর্ধশত কোটি মানুষ। তাই ঘূর্ণিঝড়ে হতাহতের ঘটনাও বেশি হয় এই সমুদ্রকে ঘিরে। আর এর প্রধান কারণ জলোচ্ছ্বাস। বঙ্গোপসাগরে সংঘটিত ঘূর্ণিঝড়ের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো জলোচ্ছ্বাস। কখনও কখনও জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা উঠে যায় দশ মিটার পর্যন্ত।
আবহাওয়াবিদদের মতে, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস সবচেয়ে ভয়ংকর হয়ে ওঠে অবতল আকৃতির অগভীর বে বা উপসাগরে। মৌসুমী ঘূর্ণিঝড়ের তীব্র বাতাস যখন এ রকম জায়গায় সাগরের পানিকে ঠেলতে থাকে, তখন ফানেল বা চোঙার মধ্যে তরল যে আচরণ করে, এখানেও তাই ঘটে। সাগরের ফুঁসে ওঠা পানি চোঙা বরাবর ছুটতে থাকে। বঙ্গোপসাগরের জলোচ্ছ্বাসের কারণও সেটাই। ভূতাত্ত্বিকদের মত, বঙ্গোপসাগরের ত্রিভুজাকৃতি এবং এর অগভীর তলদেশই ঘূর্ণিঝড়ে জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি হওয়ার কারণ।
এ ছাড়া বঙ্গোপসাগরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় আরও বাড়তি কিছু বৈশিষ্ট্য। এই সমুদ্র খুবই উষ্ণ, গ্রীষ্মে ব্যাপকহারে বেড়ে যায় সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা। ফলে এই সমুদ্রের বাতাসে জমা হয় প্রচুর জলীয় বাষ্প। ক্রমাগত বৃষ্টিপাত এই আর্দ্রতাকে ধরে রাখে। ফলে নিম্নচাপ থেকে ঘূর্ণিঝড় এবং ঘূর্ণিঝড় থেকে মহাঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে বেশি সময় লাগে না এই সমুদ্রে। পাশাপাশি, বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রকোপে ঘূর্ণিঝড়ের প্রস্তুতক্ষেত্র আরো উর্বর হয়েছে বঙ্গোপসাগরের বুকে।
বঙ্গোপসাগরের মতো পৃথিবীর নানা অঞ্চলে আরও অনেক উপসাগর আছে যেখানে উপকূল বরাবর এই ধরনের জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকি আছে। তবে অতিরিক্ত তাপমাত্রা এবং অগভীর সমুদ্রের কারণে বিশ্বের আর যে কোনো উপকূলের চেয়ে বঙ্গোপসাগরের উত্তর উপকূল অর্থাৎ যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান সেখানে এই জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
বঙ্গোপসাগরে জন্ম নেয়া ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলাদেশ। গত ২০০ বছরে পৃথিবীর ৪২ শতাংশ ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় তাণ্ডব চালিয়েছে বাংলাদেশে। প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ২০ লাখ মানুষ। ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশের ভোলায় যে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল, সেটি ছিল বিশ্বের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড়। এতে মারা যায় প্রায় ৫ লাখ মানুষ। এই ঘূর্ণিঝড়ের সময় যে জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল তার উচ্চতা ছিল ১০ দশমিক ৪ মিটার বা ৩৪ ফুট।
এ এস/
Discussion about this post