বিশ্বের গণতন্ত্রের ইতিহাসে ২০২৪ সালকে একটি নজিরবিহীন বছর হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। কারণ, এই বছরে বিশ্বের যত দেশে জাতীয় স্তরে নির্বাচন হবে, তা আগে কোনোদিন কখনও হয়নি। আন্তর্জাতিক সাময়িকী ‘টাইম’ জানাচ্ছে, এ বছরে অন্তত ৬৪টি দেশে এবং তার সঙ্গে সমগ্র ইউরোপীয় ইউনিয়নে ভোট হওয়ার কথা। এর অর্থ হলো—বিশ্বের জনসংখ্যার ৪৯ শতাংশ বা অর্ধেকই এ বছর ভোট দেবেন।
আর সারা বিশ্বে চলতি বছরে গণতন্ত্রের এই জয়যাত্রার সূচনা হচ্ছে আগামী ৭ জানুয়ারি, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন মধ্য দিয়ে।
এরপর একে একে তাইওয়ান, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, রাশিয়া, মেক্সিকো, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইউরোপীয় পার্লামেন্টসহ বিভিন্ন জায়গায় প্রেসিডেন্ট বা পার্লামেন্ট (জাতীয় আইনসভা) নির্বাচনের জন্য ভোট অনুষ্ঠিত হবে। এরপর বছরের শেষ দিকে নভেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য ভোটগ্রহণ হবে, আর নতুন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট নির্বাচনের জন্য যুক্তরাজ্যে ভোট হওয়ার কথা রয়েছে ডিসেম্বরের মধ্যেই।
টাইম ম্যাগাজিনের ভাষায়, ‘২০২৪ সালকে শুধু ইলেকশন ইয়ার বলা ঠিক হবে না, সম্ভবত এটা হলো ‘দ্য ইলেকশন ইয়ার’!’
তারা আরও বলছে, ‘বিশ্বের ইতিহাসে কখনও এত বেশি ভোটার একটি বছরে তাদের জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেননি, তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। এসব নির্বাচনের অনেকগুলোরই প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী, আগামী বহু বছর ধরে সেগুলোর অভিঘাত টের পাওয়া যাবে।’
এ প্রসঙ্গে টাইম ম্যাগাজিন দৃষ্টান্ত দিয়েছে তাইওয়ানের—যেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য ভোট হবে বাংলাদেশের ঠিক পরপরই, ১৩ জানুয়ারি। টাইম বলছে, ‘বেইজিং এই স্বশাসিত দ্বীপটিতে বহুদিন ধরেই অভিযান চালানোর হুমকি দিয়ে আসছে। এখন তাইওয়ানের নতুন প্রেসিডেন্ট কে হন—তার ওপরই সম্ভবত নির্ভর করবে তাইওয়ানের প্রতি চীনের দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে।’
একইভাবে রাশিয়ায় চলতি বছরে যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা, তাতে ভ্লাদিমির পুতিনের জয় একরকম নিশ্চিত হলেও টাইম ম্যাগাজিন মনে করছে—প্রার্থীদের কে কত ভোট পেয়েছেন, সেই সত্যিকারের পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হলে হয়তো বোঝা যাবে রাশিয়ার মানুষ ইউক্রেনের বিরুদ্ধে পুতিনের ‘অন্তহীন’ যুদ্ধকে কতটা সমর্থন করছেন। অপর দিকে ইউক্রেনেও এ বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা, কিন্তু আক্রান্ত এই রাষ্ট্রটি এখন ‘মার্শাল ল-র অধীনে। কাজেই প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ২০২৪ সালে এই ভোট করাবেন কিনা, তা এখনও নিশ্চিত নয়।
এছাড়া নভেম্বরে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও ২০১৮ সালের মতোই জো বাইডেন বনাম ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বিতার পুনরাবৃত্তি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ এর মধ্যেই পূর্বাভাস করে রেখেছে— ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে আবারও ফিরে আসেন সেটা হবে ২০২৪ সালে ‘বিশ্বের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ’!
আবার বছরের একেবারে শেষ দিকে যুক্তরাজ্যের নির্বাচন, সেখানে লেবার পার্টি জনমত জরিপে এই মুহূর্তে এগিয়ে থাকলেও প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের নেতৃত্বে কনজারভেটিভরা বাজিমাত করতে পারেন কিনা, সেদিকেও সারা বিশ্বের নজর থাকবে।
ফলে বিভিন্ন কারণে বিশ্বের গণতান্ত্রিক চর্চার নিরিখে ২০২৪ সালটি একরকম ‘ঐতিহাসিক’ হতে যাচ্ছে– তাতে কোনও সংশয় নেই। বাংলাদেশের জন্য এই মাইলফলকটি আরও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সারা বিশ্বে ইতিহাস গড়ার এই কাজটা শুরু হচ্ছে বাংলাদেশকে দিয়ে।
মাত্র ৫২ বছরের নবীন দেশ হলেও বাংলাদেশও কিন্তু গণতান্ত্রিক পরম্পরা আর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে একটি ঐতিহ্য তৈরি করে ফেলতে পেরেছে– সারা বিশ্বই সে কথা মানে। আগামী রবিবার ৭ জানুয়ারির নির্বাচনও হচ্ছে সেই ধারাবাহিকতায়, কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, বাংলাদেশের বিরোধী দল বিএনপি সেই ইতিহাসে শামিল না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করছে।
২০২৪ সালে যেসব জায়গায় ভোট হওয়ার কথা—জনসংখ্যার বিচারে সে রকম প্রথম ১০টি দেশ বা ব্লকের নাম ক্রমানুসারে নিচে দেওয়া হলো—
ভারত (১৪৪ কোটি জনসংখ্যা), সাধারণ নির্বাচন এপ্রিল/মে নাগাদ
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (৪৪.৮ কোটি জনসংখ্যা), ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচন ৬-৭ জুন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (৩৪.১ কোটি জনসংখ্যা), প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ৫ নভেম্বর
ইন্দোনেশিয়া (২৭.৯ কোটি জনসংখ্যা), প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ১৪ ফেব্রুয়ারি
পাকিস্তান (২৪.৩ কোটি জনসংখ্যা), ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির নির্বাচন ৮ ফেব্রুয়ারি
বাংলাদেশ (১৭.৪ কোটি জনসংখ্যা), জাতীয় সংসদ নির্বাচন ৭ জানুয়ারি
রাশিয়া (১৪.৪ কোটি জনসংখ্যা), প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ১৫-১৭ মার্চ
মেক্সিকো (১২.৯ কোটি জনসংখ্যা), প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ২ জুন
যুক্তরাজ্য (৬.৮ কোটি জনসংখ্যা), হাউজ অব কমন্সের নির্বাচন, ডিসেম্বরে প্রত্যাশিত
দক্ষিণ আফ্রিকা (৬.০৭ কোটি জনসংখ্যা), ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির নির্বাচন ১০ এপ্রিল
২০২৪ সালে যেভাবে আইসল্যান্ড থেকে মলডোভা বা তাইওয়ান থেকে টুভালু—বিশ্বের নানা প্রান্তে একের পর এক নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেটা একটা যুগান্তকারী ঘটনা। তবে ‘নির্বাচনি ঘটনার ঘনঘটা’ যে শুরু হচ্ছে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত এক সুজলা-সুফলা প্রান্তর থেকে, সেটাও হয়তো নেহায়েতই সমাপতন নয়!
এফএস/
Discussion about this post