গেল নভেম্বরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ভারত থেকে কেনা হয় ৭ কোটি টাকার পেঁয়াজের বীজ। যা বৃহত্তর ফরিদপুরের পাঁচ জেলার ১০ হাজার ৮২০ চাষির মাঝে দেয়া হয় বিনামূল্যে। কিন্তু দুইমাস পেরিয়ে গেলেও জমিতে পেঁয়াজের কলি নয়, বরং গজিয়েছে ঘাস আর লতাপাতা। এতে চরম ক্ষতির মুখে কৃষকরা। এরইমধ্যে ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)।
কাস্তে আর কোদাল হাতে মাঠে মাদারীপুর সদর উপজেলার পেয়ারপুরের কৃষক মোশারফ বেপারী ও এনায়েত হোসেন। ৩৩ শতাংশ জমিতে রোপণ করেছিলেন ভারতীয় পেঁয়াজের দানা। সরকারিভাবে বিনামূল্যে পেঁয়াজের বীজ পেলেও চাষাবাদ করতে খরচ হয়েছে আরও ৪০ হাজার টাকা। কিন্তু দুই মাসের মাথায় বীজ থেকে কলির বদলে গজিয়েছে ঘাস আর লতাপাতা। এমন চিত্র মাদারীপুরের ৬০০ কৃষকের জমিতে।
বিএডিসি থেকে দেয়া গোপালগঞ্জ জেলার কৃষকদের প্রণোদনার বীজও অঙ্কুরেই নষ্ট ফসলি জমিতে। পেঁয়াজ চাষের জন্য প্রস্তুত রাখা জমিতে এখন অন্য কোনো ফসলও বুনতে পারছেন না কৃষকরা। ফলে চরম লোকসানের মুখে তারা। ভারতীয় এই পেঁয়াজের বীজ জমিতে রোপণ করে দিশেহারা রাজবাড়ী জেলার কৃষকরাও।
কৃষকদের অভিযোগ, স্থানীয় চাষিদের কাছ থেকে বীজ কেনার কথা থাকলেও নিম্নমানের পেঁয়াজের দানা কেনা হয়েছে ভারতের হায়দ্রাবাদ থেকে। যা সরবরাহ করায় সৃষ্টি হয়েছে এমন পরিস্থিতির।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গোল্ডেন এন্টারপ্রাইজ নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কেনা হয় পেঁয়াজের বীজ। অথচ কাগজে-কলমে স্থানীয় কৃষকদের কাছ পেঁয়াজের বীজ কেনার কথা। মোট সাত কোটি ২০ লাখ টাকায় কেনা হয় বারি-১, বারি-৪ ও তাহেরপুরি জাতের পেঁয়াজের বীজ।
অভিযোগ ওঠায় এরইমধ্যে তদন্ত শুরু করে করেছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের প্রধান কার্যালয়। এ ঘটনায় জড়িতদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি তুলেছেন প্রান্তিক চাষিরা।
জানা যায়, ফরিদপুরের ৫২০০ জন কৃষককে দেয়া হয় এই পেঁয়াজের বীজ। রাজবাড়ী জেলার বীজ পাওয়া কৃষকদের সংখ্যা ৪০০০ জন। এছাড়া মাদারীপুরে ৬০০ ও শরিয়তপুর জেলার ৬০০ কৃষককে বিনামূল্যে দেয়া হয় ভারতীয় এই পেঁয়াজের বীজ। এদিকে গোপালগঞ্জের ৪২০ জনকে পেঁয়াজের বীজ প্রণোদনা হিসেবে দেয়া হয়। কিন্তু অধিকাংশ কৃষকের জমিতেই হয়নি ফসল উৎপাদন।
মাদারীপুর সদর উপজেলার পৌর পেয়ারপুর গ্রামের কৃষক বাচ্চু হোসেন বলেন, এবার এমন পঁচা বীজ দিয়েছে একটি পেঁয়াজের কলিও গজাইনি। আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে। আমরা ক্ষতিপূরণ চাই।
মাদারীপুরের বলাইরকান্দি গ্রামের আরেক কৃষক সরদার মতিউর রহমান বলেন, সরকার থেকে বিনামূল্যে ভারতীয় পেঁয়াজের দানা পেয়ে খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু জমিতে রোপণ করে এখন মাথায় হাত। এই ঘটনার জড়িতদের বিচার করা উচিত।
রাজবাড়ীর কৃষক ইউনুস আলী মোল্লা বলেন, সরকার থেকে আমাদের কৃষকদের যে পেঁয়াজের বীজ দিয়েছে তা কোনো কাজেই লাগেনি। এই বীজ গজাইনি। আমাদের সম্পূর্ণ জমিই এখন অলস পড়ে আছে।
রাজবাড়ীর বড় ভবানীপুর গ্রামের কৃষক মো. আমিন খান বলেন, ‘সরকার থেকে আমাদের পেঁয়াজের বীজ দিয়েছিল, এই বীজটা মাইর গেছে। এতে আমরা সব কৃষকই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। পরে ৫ হাজার টাকা পেঁয়াজের বীজ কিনে এনে পুনরায় রোপণ করাতে এখন গজিয়েছে। আমাদের প্রথম ধাপে অনেক টাকা ক্ষতি হয়েছে।’
গোপাগঞ্জের কৃষক আব্দুল জব্বার মিয়া বলেন, ‘আমাকে বিএডিসি অফিস থেকে ৫০০ গ্রাম করে দুই প্যাকেটে এক কেজি পেঁয়াজের বীজ দিয়েছে। এতে আমার বড় ক্ষতি হয়েছে, আমি এই ক্ষতিপূরণ চাই।’
বিএডিসির ফরিদপুর অঞ্চলের সহকারী পরিচালক মো. সাইয়ুম মল্লিক বলেন, বারি-১ পেঁয়াজের বীজ রোপণের পর গজিয়েছে। এছাড়া বাকি বীজ না গজানোর কারণ অনুসন্ধানে অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত করছে প্রধান কার্যালয়। এখানে আমাদের ফরিদপুর অফিসের কোনো হাত নেই।
বিএডিসির ফরিদপুর অঞ্চলের উপপরিচালক মাহমুদুল ইসলাম খান জিয়া বলেন, ‘আমার চুক্তিবদ্ধ চাষিদের কাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করে বিতরণ করেছি। সেক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হয়নি। তবে ঠিকাদারের মাধ্যকে ক্রয়করা পেঁয়াজের বীজে কিছুটা সমস্যা হয়েছে। সেটা চাষাবাদে সমস্যা হওয়ার কারণে হতে পারে।’
আর এম/
Discussion about this post