ভারতের উত্তরপ্রদেশের সামভালে মুঘল আমলের একটি মসজিদকে ঘিরে ব্যাপক উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। প্রাচীন এই মসজিদে ‘সার্ভে’ বা সমীক্ষা করানোর নির্দেশকে ঘিরে স্থানীয় জনতা ও পুলিশের মধ্যে দফায় দফায় তীব্র সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে, যাতে অন্তত তিনজন মুসলিম নিহত হয়েছেন। নিহত তিনজনের নাম নাঈম, বিলাল ও নোমান।
এই ঘটনার পর সামভালে ইন্টারনটে পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একদিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সেখানকার সকল স্কুল। ভারতীয় বার্তাসংস্থা পিটিআইয়ের বরাত দিয়ে সোমবার (২৫ নভেম্বর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দু।
সংবাদমাধ্যম বলছে, উত্তরপ্রদেশের সামভালে মুঘল আমলের একটি প্রাচীন মসজিদে ‘সার্ভে’ বা সমীক্ষা করানোর নির্দেশকে ঘিরে স্থানীয় জনতা ও পুলিশের মধ্যে রোববার দফায় দফায় তীব্র সংঘর্ষের ঘটনায় অন্তত তিন জন নিহত হয়েছেন। সহিংসতায় আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৩০ জন পুলিশ সদস্য।
ঘটনার পর গোটা এলাকায় তীব্র সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাও ছড়িয়ে পড়েছে বলে জানা যাচ্ছে। শহরের যে মসজিদটিকে ঘিরে এই বিরোধ দেখা দিয়েছে সেটি ‘শাহী জামা মসজিদ’ নামে পরিচিত। হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলির দাবি, প্রাচীন একটি হিন্দু মন্দির ভেঙেই এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল, ওই ভবনের স্থাপত্যে নাকি এখনও তার প্রমাণ রয়েছে।
রোববারের এই সংঘর্ষের সময় বিক্ষোভকারীরা যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করে এবং পুলিশকে লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়ে মারে। অন্যদিকে বিক্ষুব্ধ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপের পাশাপাশি ও লাঠিচার্জ করে পুলিশ।
মোরাদাবাদের বিভাগীয় কমিশনার অঞ্জনেয়া কুমার সিং জানিয়েছেন, “দুর্বৃত্তরা গুলি চালিয়েছিল… পুলিশ সুপারের পিআরও’র পায়ে গুলি লেগেছে, পুলিশ সার্কেল অফিসার পেলেটের আঘাতে আহত হয়েছেন এবং সহিংসতায় ১৫ থেকে ২০ জন নিরাপত্তা কর্মী আহত হয়েছেন।”
তিনি আরও দাবি করেন, একজন কনস্টেবলের মাথায়ও গুরুতর আঘাত লেগেছে এবং ডেপুটি কালেক্টরের পা ভেঙে গেছে।দ্য হিন্দু বলছে, সংঘর্ষের এই ঘটনার পর সামভাল তহসিলে ইন্টারনেট পরিষেবা ২৪ ঘণ্টার জন্য স্থগিত করে দেওয়া হয়েছে এবং জেলা প্রশাসন ২৫ নভেম্বর (সোমবার) দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সমস্ত ছাত্রদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি ঘোষণা করেছে।
এদিকে হিন্দু মন্দির ভেঙে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল বলে যে দাবি করা হচ্ছে সেটাকে কেন্দ্র করে হিন্দু ও মুসিলম গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে আদালতে আইনি লড়াইও চলছে দীর্ঘদিন ধরে। সম্প্রতি আদালত ওই মসজিদ প্রাঙ্গণে সার্ভে করানোর নির্দেশ দেওয়ার পর থেকেই নতুন করে উত্তেজনা ছড়ায়।
ওই মসজিদ ভবনটিতে আগে কোনও হিন্দু মন্দিরের অস্তিত্ব ছিল কি না, সেটা যাচাই করে দেখার জন্যই ওই সার্ভের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।জানা যায় মুঘল আমলে একটি প্রাচীন হিন্দু মন্দির ভেঙে এই জামা মসজিদ নির্মিত হয়েছিল এবং এখন তা হিন্দুদের হাতে ফিরিয়ে দিতে হবে– এই দাবি নিয়ে একদল আবেদনকারী আদালতের শরণাপন্ন হলে এই সার্ভের নির্দেশ দেওয়া হয়।
ওই আবেদনকারীদের যুক্তি ছিল, ‘বাবরনামা’ ও ‘আইন-ই-আকবরী’র মতো ঐতিহাসিক গ্রন্থেই প্রমাণ আছে যে– ১৫২৯ সালে মুঘল বাদশাহ বাবর সামভালে হিন্দু মন্দির ভেঙে ওই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল।এই ‘ঐতিহাসিক সত্য’টি উদঘাটন করার জন্যই শাহী জামা মসজিদে সার্ভে চালানো প্রয়োজন বলে তারা দাবি করে আসছিলেন।
অন্যদিকে মসজিদ কর্তৃপক্ষ ও সার্ভের বিরোধীদের বক্তব্য ছিল, ভারতের ধর্মীয় উপাসনালয় আইন ১৯৯১ অনুসারে দেশের স্বাধীনতার সময় কোনও মন্দির, মসজিদ বা গীর্জার চরিত্র যা ছিল তা বদলানো যায় না – সুতরাং সামভালের জামা মসজিদেও এই ধরনের হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়।
এছাড়া মসজিদে এভাবে ‘সার্ভে’ চালানো হলে তা এলাকায় অযথা উত্তেজনা ছড়াবে বলেও তারা সতর্ক করে আসছিলেন।
Discussion about this post