গোটা বিশ্ব যখন অন্যায়-অবিচার, জুলুম ও নানা কুসংস্কারে নিমজ্জিত হয়েছিল ঠিক তখনই আল্লাহ তাআলা হিদায়াতের আলোকবর্তিকা হিসেবে পৃথিবীর বুকে পাঠিয়েছেন প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের রবিউল আউয়াল মাসে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের সময় পৃথিবীতে এমন কিছু অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল, যা সবাইকে অবাক করে ও শ্রেষ্ঠ নবীর আগমনকে মানুষের সামনে স্পষ্ট করে। এমনই কিছু ঘটনা তুলে ধরা হলো। বিশ্ব নবী (সা.)-এর জন্মের কিছুদিন আগে আবরাহার হস্তী বাহিনীর বিনাশ ঘটে। আসহাবে ফিল অর্থাৎ আবরাহার হস্তী বাহিনী খানায়ে কাবার ওপর আক্রমণ করেছিলএবং আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে আবাবিল নামক কিছু ক্ষুদ্র পাখি দ্বারা পরাজিত করেছিলেন। এ ঘটনাটি বিশ্ব নবীর জন্মের বরকতের পঠভূমি ছিল বলে সিরাতের কিতাবগুলোতে উল্লেখ রয়েছে।
হজরত উসমান ইবনে আবুল আস (রা.)-এর মা হজরত ফাতেমা বিনতে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.)-এর জন্মের মুহূর্তে আমি মা আমিনার কাছে ছিলাম। আমি দেখলাম, বিবি আমিনার ঘরটি আলোয় আলোকিত হয়ে গেল এবং আকাশের সব তারকা নিচের দিকে ঝুঁকে পড়ল। আমার মনে হতে লাগল, তারকাগুলো যেন আমার ওপর এসে পড়বে।’ (ফাতহুল বারী : ৬/৭২৬)
লক্ষণীয় বিষয় হলো, তারকারাজির নিম্নমুখী হয়ে ঝুঁকে পড়ার দ্বারা এই ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে যে, অচিরেই পৃথিবী থেকে কুফর ও শিরকের অমানিশা দূর হবে এবং হেদায়েতের উজ্জ্বল আলোকে এ নিখিলধরা আলোকিত হয়ে উঠবে। মহান আল্লাহ পাক তাঁর পবিত্র কালামে এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে আলোচনা করেছেন। তিনি ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় তোমাদের কাছে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এসেছে (হেদায়েত) আলো এবং সুস্পষ্ট কিতাব। যারা তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে এই হেদায়েতের আলোকবর্তিকা ও কিতাবের সাহায্যে শান্তির পথে পরিচালনা করেন এবং তাঁরই অনুমতিক্রমে কুফর, শিরকের অন্ধকার থেকে তাদেরকে হেদায়েতের পথে নিয়ে আসেন’ (সুরা মায়েদা : ১৫-১৬)। হজরত ইরবায ইবনে সারিয়া (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রাসুল (সা.)-এর সম্মানিত মা রাসুল (সা.-এর শুভজন্মক্ষণে এক নূর দেখেন, যার দ্বারা সিরিয়া এলাকার প্রাসাদগুলো উজ্জ্বলভাবে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।’ (মাজমাউ যাওয়ায়েদ : ৮/২২২)
বিশ্বনবীর জন্মক্ষণে একদিকে পৃথিবীর মূর্তিশালায় নবুয়তের সূর্যোদয়, অপরদিকে পারস্য সম্রাট কিসরার রাজপ্রাসাদে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। এই ভূমিকম্পের দরুন রাজপ্রাসাদের ১৪টি গম্বুজ ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। পারস্যের এক অগ্নিকুণ্ড, যা এক হাজার বছরব্যাপী বিরতিহীনভাবে জ্বলছিল তা সেই শুভ মুহূর্তে হঠাৎ নিভে যায়। সাওয়াহ নামক এক নদীতে যথারীতি পানি প্রবাহিত হচ্ছিল, বিশ^নবীর আগমন মুহূর্তে হঠাৎ তার অথৈ জলরাশি শুকিয়ে যায়’ (সিরাতে মুস্তফা : ১/৬৯)। প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল অগ্নিপূজাসহ সব ভ্রান্তির অবসানের ইঙ্গিত।
সহিহ হাদিসে বর্ণিত, জন্মের সময় বিশ্ব নবীর মায়ের পেট থেকে এমন একটি নূরের বিচ্ছুরণ ঘটেছিল, যার আলোকে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিগন্ত পর্যন্ত সবকিছু আলোকিত হয়ে গিয়েছিল। কোনো কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায়, বিশ্ব নবী (সা.) যখন ভূমিতে আবির্ভূত হলেন তখন উভয় হাতের ওপর ভর দিয়ে ছিলেন। অতঃপর এক মুষ্টি মাটি নিয়ে আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন।’ (মাওয়াহিবে লাদুন্নিয়া )
হজরত ইবনে সুফিয়ান বর্ণনা করেছেন, আয়শা (রা.) বলেন, ‘ বিশ্ব নবী (সা.)-এর জন্মগ্রহণের সময় এক ইহুদি ব্যবসার উদ্দেশ্যে মক্কা নগরীতে বসবাস করত। যে রাতে বিশ্বনবী পৃথিবীতে আগমন করেন, সে রাত-পরবর্তী সকালে সে কুরাইশদের কাছে জিজ্ঞেস করল, গত রাতে এ এলাকাতে কোনো শিশুর জন্ম হয়েছে কি? উপস্থিত কুরাইশের লোকেরা বলল, এ বিষয়ে আমরা কিছু জানি না। লোকটি বলল, তোমরা এ বিষয়টির অনুসন্ধান করো। কেননা এই রাতে বর্তমান উম্মতের নবী ভূমিষ্ঠ হয়েছেন। তাঁর কাঁধের মধ্যবর্তী স্থানে একটি বিশেষ নিদর্শন (অর্থাৎ মোহরে নবুয়ত) রয়েছে। জন্মের পরপর শিশুটির মুখে জিন আঙুল পুরে রাখার দরুন শিশুটি দুদিন ধরে কারও দুধ পান করবে না। কুরাইশের লোকেরা সন্ধান করে জানতে পারল, আবদুল মুত্তালিবের প্রিয় পুত্র আব্দুল্লাহর এক পুত্রসন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে। ইহুদিকে এ সংবাদ জানানো হলে সেও শিশুটিকে দেখার আগ্রহ ব্যক্ত করে বলল, চলো। আমিও শিশুটিকে দেখব। ইহুদি লোকটি যখন শিশুটিকে দেখল এবং তাঁর দুই কাঁধের মাঝে মোহরে নবুয়তের নিদর্শনও দেখতে পেল, তখন সে চিৎকার দিয়ে বেঁহুশ হয়ে গেল। হুঁশ ফিরে আসার পর লোকটি বলল, ‘নবুয়তে বনি ইসরাইল আজ থেকে শেষ হয়ে গেল। হে কুরাইশ সম্প্রদায়! ভবিষ্যতে এই শিশু তোমাদের প্রতি এমন এক আক্রমণ পরিচালনা করবে, যার সংবাদ পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে।’ (ফাতহুল বারী : ৬ /৪২৫) এ ছাড়া আরও অনেক আশ্চর্যজনক ঘটনা সিরাতের পাতায়-পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। আসুন আমরা বিশ্বনবীর এ জন্মের মাসে বেশি বেশি সিরাত পাঠ করি এবং বিশ্ব নবীর শানে দরুদ পাঠ করি। ‘আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মোহাম্মদ…।
এস আই/
Discussion about this post