দালালদের খপ্পরে পড়ে বহু মানুষ সাগরপথে ইউরোপ যাওয়ার পথে নৌকা ডুবে মারা যাচ্ছে। আর এসব ঘটায় গত ১০ বছরে শুধু মাদারীপুরেই ৩২৯টি মানব পাচার মামলা হয়েছে। তবে এসব মামলার একটিরও বিচার হয়নি।
অভিবাসন খাত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নত জীবনের আশায় দালালদের খপ্পরে পড়ে ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরছে বাংলাদেশি তরুণরা। দেশে বেকারত্ব, বৈধপথে ইউরোপে যাওয়ার সুযোগ কম থাকায় তারা বিকল্প পথ খুঁজে নিচ্ছে। আর সেই সুযোগ কাজে লাগায় দালালরা। ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে তারা লাপাত্তা হয়ে যায়। এদিকে সাগরে ডুবে মরতে হচ্ছে তরুণদের। সরকারের উচিত কঠোর হাতে দালালদের প্রতিহত করা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১০ বছরে মাদারীপুরে ৩২৯টি মানব পাচার মামলা হয়েছে। তবে এসব মামলার একটিরও বিচার হয়নি। ফলে দালালরা দ্বিতীয়বার এমন কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে। এ ছাড়া গত ১০ বছরে দালালদের খপ্পরে পড়ে মাদারীপুরের প্রায় ১০০ যুবকের মৃত্যু হয়েছে। এদিকে ইতালি যাওয়ার আগে লিবিয়ায় নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে বাড়ি ফেরা মানুষের সংখ্যাও কম নয়।
২০১৩-২৩ এই ১০ বছরে মাদারীপুরের বিভিন্ন থানায় মামলার সংখ্যা ২৯২টি ও আদালতে ৩৭টি মামলা করে ভুক্তভোগীর পরিবার। মামলায় আসামি ১ হাজার ৪৬৬ জন হলেও গ্রেপ্তার হয়েছে ২৮৭ জন। আর আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয় ৯৬টি মামলার। এর মধ্যে আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা পড়ে ৮৭টি মামলার। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত ১১১টি মামলা মীমাংসা হওয়ায় বাদী মামলা প্রত্যাহার করেছেন। গত ১০ বছরে অবৈধপথে ইতালি পাড়ি জমিয়েছে ৫ হাজার ৫০০ জন।
মামলার এজাহার, ভুক্তভোগীদের স্বজন ও জেলা পুলিশের তথ্যমতে, মাদারীপুরসহ বিভিন্ন জেলায় সক্রিয় দালালদের নাম পাওয়া গেছে।
মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মাসুদ আলম বলেন, ‘শুধু আইনের প্রয়োগ করেই দালালদের নির্মূল করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন, পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিদের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। তাহলে সমাজ থেকে দালাল নির্মূল হবে। এ ছাড়া মানব পাচার মামলায় অনেক দালাল গ্রেপ্তারের পর জামিনে বেরিয়ে এসে আবারও একই কাজে লিপ্ত হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুললেই এ ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি হবে না।
মাদারীপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মারুফুর রশিদ খান বলেন, মাদারীপুরের বেশিরভাগ মানুষের অবৈধভাবে দালালের মাধ্যমে ইতালি যাওয়ার প্রবণতা বেশি। আমরা বিভিন্ন সময় ক্যাম্পেইন করছি, যাতে দালালদের প্রলোভনে তারা উৎসাহিত না হন। এ ছাড়া অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবুও তরুণরা এ পথে পা বাড়াচ্ছে। পরিবারের সদস্যদের সব থেকে বেশি সচেতন হতে হবে। নয়তো এ প্রবণতা কমবে না।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত শুধু ইতালিতে অবৈধভাবে পাড়ি দিয়েছেন ২২ হাজার ৭৭৮ বাংলাদেশি, যা দেশটিতে মোট অবৈধ অভিবাসীর ১৪ শতাংশ। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) মিসিং মাইগ্রেন্টের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আগের বছরগুলোর তুলনায় ভূমধ্যসাগরে ডুবে মৃত্যু এবং নিখোঁজের সংখ্যা বাড়ছে। ২০২১ সালে ২ হাজার ৪৮, পরের বছর ২ হাজার ১১ এবং ২০২৩ সালে ৩ হাজার ৪১ জন নিখোঁজ অথবা ডুবে মারা গেছে ভূমধ্যসাগরে। তাদের মধ্যে কয়েকশ বাংলাদেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিসংখ্যান দপ্তর ইউরোস্ট্যাটের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সাল পর্যন্ত সোয়া এক লাখ বাংলাদেশি অবৈধভাবে জোটভুক্ত দেশগুলোতে ছিল। ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ইতালিতে অবৈধভাবে ১৫ হাজার ২২৮ এবং ২০২১ সালে ৭ হাজার ৮৩৮ জন যায়, তাদের ৯৮ শতাংশই গেছে লিবিয়া হয়ে।
ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ২৩ লাখেরও বেশি মানুষ সাগরপথ পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢুকেছে। একই সময়ে ইউরোপে ঢুকতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে ২৭ হাজার ৬৮২ জন। যাদের মধ্যে অনেক বাংলাদেশি আছে। প্রতি বছর গড়ে কমপক্ষে ৫০০ বাংলাদেশি এভাবে প্রাণ হারায়। আমরা এক গবেষণায় দেখেছি, ৩১ থেকে ৩৫ বছরের যুবকরা বেশি অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করে। গত সাত বছরে ইউরোপ ও লিবিয়া ফেরত তিন হাজারের বেশি মানুষের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। তারা জানিয়েছে, অবৈধভাবে দালালের খপ্পরে পড়ে একেকজনের খরচ হয় ১৫ লাখ টাকা। সরকারের উচিত এসব বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া। যাতে তরুণরা বৈধভাবে বিদেশে যেতে উৎসাহী হয়।
সূত্র: দেশ রূপান্তর
এফএস/
Discussion about this post