যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশিদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় একটি যোগাযোগমাধ্যম টিকটক। সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশি নারীরা ট্রলের শিকার টিকটকের মাধ্যমে ট্রলের শিকার হচ্ছেন। এসব ট্রলের কারণে তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে।
এমনকি অনেকে আত্মহত্যার কথাও ভাবছেন। বিবিসির অনুসন্ধানে এ ভয়ংকর চিত্র ওঠে এসেছে। সংবাদমাধ্যমটি মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
তাতে বলা হয়, নারীদের নিপীড়ন ও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ভুক্তভোগীরা যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের পুলিশ এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করছেন কিন্তু কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। যুক্তরাজ্যের ইয়র্কশায়ারে বসবাস করেন সুলতানা (ছদ্মনাম)। তিনি জানান, নারীবিদ্বেষ ও বাজে সম্পর্কের বিষয়ে আওয়াজ তুলতে তিনি টিকটক ব্যবহার করছিলেন। কিন্তু তিনি ২০২১ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রলের শিকার হন। মূলত ট্রলের শিকার হওয়া তার এক বন্ধুর পক্ষে কথা বলার পর তিনিও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন।
এ ট্রল তাকে মানসিকভাবে কতটা বিপর্যস্ত করে তুলে সে বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মনে হচ্ছে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। আমি কান্না করেছি। আমি খেতে পারিনি। ঘুমাতে পারিনি। মনে হচ্ছিল, এখানে আর থাকতে চাই না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি কাজে ছিলাম। এ সময় আমার কয়েকজন টিকটক ফলোয়ার আমাকে খুদে বার্তা পাঠান।
তারা জিজ্ঞাসা করছিলেন, আমি সেই ভিডিওগুলো (ট্রল করে করা ভিডিও) দেখেছি কি না। সেই ভিডিও ও পোস্টগুলোতে লোকজন কমেন্ট করছিল। আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছিল। এ ধরনের নিপীড়ন দুই বছর ধরে চলে। এটা এমন এক অবস্থা যা তিনি কখনো ভুলতে পারব না।’
সুলতানা বলেন, ‘আমার মানসিক স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। সুস্থ হতে থেরাপি নিয়েছি। ট্রলের ঘটনাগুলো আমার অসুস্থতা বাড়িয়ে দিয়েছে। এমনকি তা আমাকে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারের দিকে ঠেলে দেয়।’
যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশিদের মধ্যে টিকটক বেশ জনপ্রিয়। বিশেষ করে রক্ষণশীল পরিবারের নারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটি ব্যবহার করে নানা ইস্যুতে কথা বলেন। ভুক্তভোগীরা বলেন, নারীদের এ মতামত প্রকাশ বাংলাদেশিদের অনেক পুরুষ পছন্দ করেন না। তারা নারীদের থামিয়ে দিতে চান। এ জন্যই ট্রলকে বেছে নেওয়া হচ্ছে।
সুলতানাসহ ভুক্তভোগী আরও কয়েকজন নারী বিবিসিকে জানান, হাসান সায়েদ নামের বাংলাদেশি এক ব্যক্তি ট্রলের হোতাদের একজন। তিনি ফ্রান্সের প্যারিসের একটি উপশহরে থাকেন। এ টিকটকারের হাজারো অনুসারী। হাসান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে ব্যক্তিগত ছবি ও তথ্য সংগ্রহ করেন। সেগুলো গ্রিন স্ক্রিনের সাহায্যে ট্রল ভিডিও তৈরি করেন। এরপর হাসান টিকটকে লাইভে এসে ভুক্তভোগী নারীদের চেহারা ও অন্যান্য বিষয়ে মজা করেন। তিনি নারীদের ধর্ষণ ও হত্যার হুমকিও দেন।
হাসানের আরেক শিকার যুক্তরাজ্যের ওয়েলসের এক নারী। তিনি জানান, টিকটক লাইভে তিনি নানা পণ্য বিক্রি করেন। এ লাইভে হাসান যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেন। হাসানকে পাত্তা না দেওয়ায় তাকে নিয়ে ভিডিও বানিয়ে ছড়িয়ে দেন অভিযুক্ত। ভিডিওতে ওই নারীকে ‘যৌনকর্মী’ হিসেবে প্রচার করে সম্মানহানির চেষ্টা করা হয়। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে বিবিসির পক্ষ থেকে ই-মেইল ও কল করা হয়। কিন্তু হাসান এতে কোনো সাড়া না দেওয়ায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বিবিসি জানায়, এসব ট্রলের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীরা বিভিন্নভাবে প্রতিকার পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। কামরুল ইসলাম নামে ভুক্তভোগী হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করে এসব বন্ধ করার আহ্বান জানান। এতে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে কামরুলের পরিবার নিয়ে ট্রল শুরু করেন। এসব ভিডিও সরাতে কামরুল টিকটক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু তারা তাকে সাফ জানিয়ে দেন, এসব তাদের কমিউনিটি গাইডলাইন লঙ্ঘন করেনি। তাই ভিডিওগুলো সরানো হবে না।
এ ছাড়া কামরুল পুলিশের কাছেও অভিযোগ করেন। এরপরও ট্রল না থামায় তিনি ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্যারিসে যুক্তরাজ্যের দূতাবাসে যোগাযোগ করেন। দূতাবাস ফরাসি আইনজীবী ম্যাথিউ ক্রোইজেতের সঙ্গে কামরুলের যোগাযোগ করিয়ে দেয়। কামরুলের কাছ থেকে বিস্তারিত জেনে প্যারিসের সরকারি কৌঁসুলির দপ্তরে অভিযোগ করেন এ আইনজীবী। কিন্তু এ মামলার কোনো রায় এখনো হয়নি।
অভিযোগকারী কামরুল মুসলমান হওয়ায় মামলাটি আটকে যাওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। মামলার হালনাগাদ তথ্য জানতে প্যারিসের কেন্দ্রীয় পুলিশ স্টেশন ও আদালতে যোগাযোগ করে বিবিসি। কিন্তু এ প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত কোনো প্রতিউত্তর পাওয়া যায়নি।
এ এস/
Discussion about this post