দেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম উৎস প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। এ দেশের মানুষের মধ্যে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর বিদেশে গেছেন ১২ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি কর্মী। তবে জনবল অনুযায়ী রেমিট্যান্স এসেছে কম।
রেমিট্যান্স উপার্জনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। প্রবাসী আয় হিসেবে দেশে আসে বছরে প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার, যা মোট জিডিপির ১২ শতাংশ।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে ২০২২ সালে দেশে রেমিট্যান্স আসার ক্ষেত্রে কিছুটা নেতিবাচক ধারা থাকলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে ২০২৩ সালে। এ বছর প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি অর্জনের পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
সংস্থাটির দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশের প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ। ২০২৩-এ বৈধভাবে আসা প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ছাড়িয়ে যাবে ২ হাজার ৩০০ কোটি ডলার। ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ব্রিফ-৩৯-এ রেমিট্যান্স প্রবাহের এ আশাবাদী চিত্র তুলে ধরা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গেলো বছরের প্রথম ১১ মাসে দেশে রেমিট্যান্স বাবদ এসেছে ২ হাজার ৪১ কোটি (২০.৪১ বিলিয়ন) ডলার। সবচেয়ে বেশি এসেছে জুনে। এ সময় দেশে প্রবাসী আয় এসেছে ২.১৯ বিলিয়ন ডলার। তবে সবচেয়ে কম এসেছে সেপ্টেম্বরে (১.৩৩ বিলিয়ন ডলার)। অবশ্য নভেম্বরে ফের বাড়তে শুরু করে রেমিট্যান্স আসার পরিমাণ। ওই মাসে দেশে এসেছে ১.৯৩ বিলিয়ন ডলার। এ পরিমাণ আগের বছরের একই মাসের চেয়ে ২১ শতাংশ বেশি।
২০২২-২০২৩ অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ২১.৬১ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে বিদেশে কর্মী যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ (বিএমইটি) ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিদেশে কর্মী হিসেবে গেছেন ১২ লাখ ৪৬ হাজার বাংলাদেশি। এর মধ্যে অর্ধেকই অদক্ষ। তবে ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে দক্ষ শ্রমিকের কর্মসংস্থান বেড়েছে ২২ শতাংশ। ২০২২ সালে বিদেশে দক্ষ কর্মী গিয়েছিল ২ লাখ ৫২ হাজার, ২০২৩ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩ লাখ ৮ হাজার। এছাড়া ২০২৩ সালে বিদেশে অর্ধ দক্ষ শ্রমিক গেছেন ২ লাখ ৬১ হাজার। অথচ ২০২২ সালে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ৪২ হাজার ৭৭১ জন।
পাশাপাশি এ বছর কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশ গেছেন চিকিৎসক, নার্স, ইঞ্জিনিয়ার, আইটি বিশেষজ্ঞসহ ৫০ হাজার ১৫৮ পেশাদার কর্মী। ২০২২ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৬৪০ জন। তবে বিদেশে যাওয়া বাংলাদেশি কর্মীদের বেশিরভাগেরই কর্মসংস্থান হয়েছে চালক, কেয়ারগিভার, গৃহকর্মী, আতিথেয়তা কর্মী, ইলেক্টিশিয়ান, কোয়ালিটি কন্ট্রোল সুপারভাইজার, রেফ্রিজারেশন ও এয়ার কন্ডিশনার, প্লাম্বিং ও পাইপ ফিটিং এবং সাধারণ বৈদ্যুতিক কর্মী হিসেবে।
মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসীদের নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ছে। যেসব দেশ থেকে রেমিট্যান্স আসে, তার শীর্ষ দশটি দেশের মধ্যে ছটিই মধ্যপ্রাচ্যের। মধ্যপ্রাচ্য থেকে রেমিট্যান্স প্রাপ্তির দিক থেকে শীর্ষে আছে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব। এছাড়া ওমান, কুয়েত, কাতার ও বাহরাইন থেকেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রেমিট্যান্স আসে। বাংলাদেশের জন্য আশার বিষয় হলো, আরও চাঙা হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার। ফলে সেখানে আরও বেশি বাংলাদেশি শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে।
তবে দেশ থেকে ২০২৩ সালে রেকর্ড পরিমাণে কর্মী প্রবাসে গেলেও সে অনুযায়ী বৈধপথে দেশে রেমিট্যান্স আসার পরিমাণ অনেকটাই কম। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে রেকর্ড ১২ লাখ ৪৬ হাজার কর্মী বিদেশে গেছেন। গত বছরে এ সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ৩৫ হাজার। বিদেশে কর্মী গমনে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি হলেও এর প্রভাব পড়তে দেখা যায়নি রেমিট্যান্সের প্রবাহে। কারণ, গত ২ পঞ্জিকাবর্ষেই রেমিট্যান্স আটকে ছিল ২২ বিলিয়ন ডলারের আশপাশেই। রেমিট্যান্স প্রবাহ কম হওয়ার মূল কারণ, প্রবাসীরা বৈধপথে তাদের অর্জিত আয় দেশে পাঠানোর বদলে বেছে নিচ্ছেন হুন্ডির মত অবৈধ পথ।
২০২৩ সালে দেশে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে ঢাকা বিভাগে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর মাসে এই বিভাগের ১৩ জেলায় রেমিট্যান্স এসেছে ৪ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার। গত ২০২২-২০২৩ অর্থবছরেও এই বিভাগে এসেছিল ১০ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার।
বিভাগওয়ারি রেমিট্যান্স প্রাপ্তিতে ঢাকা বিভাগের পরপরই দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগ। চলতি ২ অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর মাসে চট্টগ্রাম বিভাগে রেমিট্যান্স এসেছে ২ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরে এই বিভাগে রেমিট্যান্স আসার পরিমাণ ছিল ৫ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার।
এছাড়া অন্য বিভাগের মধ্যে চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বরের মধ্যে সিলেট বিভাগে এসেছে ১ বিলিয়ন ডলার, বরিশাল বিভাগে এসেছে ২১ দশমিক ৫ কোটি ডলার, খুলনা বিভাগে এসেছে ৩৪ দশমিক ৯ কোটি ডলার, ময়মনসিংহ বিভাগে এসেছে ১৫ দশমিক ৬ কোটি ডলার, রাজশাহী বিভাগে এসেছে ২৭ কোটি ডলার এবং রংপুর বিভাগে এসেছে সবচেয়ে কম মাত্র ১০ দশমিক ৯ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স।
এছাড়া রেমিট্যান্সের দিক থেকে দেশের শীর্ষ জেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল নোয়াখালী, ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চাঁদপুর। এসব জেলায় জুলাই থেকে নভেম্বর মাসে ২০ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছে।
রেমিট্যান্স প্রবাহের দিক থেকে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে দেশের উত্তরাঞ্চল ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলো। চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর এই পাঁচ মাসে দেশে জেলাভিত্তিক সবচেয়ে কম রেমিট্যান্স এসেছে উত্তরাঞ্চলের লালমনিরহাটে, মাত্র ৭৩ লাখ ডলার। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে রাঙ্গামাটি। সেখানে এসেছে ৭৫ লাখ ডলার। ঠাকুরগাঁয়ে এসেছে ৮১ লাখ ডলার, পঞ্চগড়ে ৯৭ লাখ ডলার আর কুড়িগ্রামে এসেছে ১ কোটি ২৪ লাখ ডলার।
এফএস/
Discussion about this post