গত ১৯ দিন যাবত বদলি সম্পূর্ণ বন্ধ থাকায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলি-প্রত্যাশী দুই লক্ষাধিক শিক্ষক-শিক্ষিকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে এই বদলি প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে শিক্ষাঙ্গন ও অভিভাবক মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলেও কোনো প্রতিকার মিলছে না। অতি জরুরি কারণে বদলি পেতে শত শত শিক্ষক-শিক্ষিকা মন্ত্রণালয়ে ধরনা দিলেও কোনো লাভ হচ্ছে না। বিশেষ করে নারী শিক্ষকরা বেশি বিপাকে পড়েছেন। তাদের সন্তান, স্বামী ও পরিবার দূর জেলায় থাকলেও সেখানে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না। অবিলম্বে বদলির আদেশ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন তারা।
জানা গেছে, গত ২৬ ডিসেম্বর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব রেবেকা সুলতানা স্বাক্ষরিত এক আদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের অফলাইন বদলি, প্রশাসনিক বদলি ও সংযুক্তি কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে গত ১ জানুয়ারি থেকে অনলাইন সফটওয়্যারের মাধ্যমে সহকারী শিক্ষকদের কেবল আন্তঃউপজেলা বা আন্তঃথানায় বদলি কার্যক্রম শুরু করার নির্দেশনা ছিল চিঠিতে। কিন্তু সেই নির্দেশনাও বাস্তবায়ন হয়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ‘মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার নির্দেশে বদলি বন্ধ রাখা হয়েছে। ঐ কর্মকর্তা বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সুবিধাভোগী। আওয়ামী লীগ সমর্থিত শিক্ষকদের যাতে বদলি করা না যায়, এ জন্যই তিনি বদলি পুরোপুরি বন্ধ রেখেছেন।’
অধিদপ্তর সূত্র ও প্রাথমিকের শিক্ষক নেতারা জানান, দেশের ৬৫ হাজার ৫৬৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৫১৩ জন শিক্ষক কর্মরত আছেন। তাদের অর্ধেকের বেশি বদলি-প্রত্যাশী। দীর্ঘদিন ধরে বদলি হতে না পারায় শিক্ষকদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা ও চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী নারী শিক্ষিকারা। অনেক স্বামী-স্ত্রী শিক্ষক দম্পতির কর্মস্থল একে অপরের থেকে প্রায় শত কিলোমিটার দূরে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সহকারী প্রাথমিক শিক্ষক সমাজের নেতারা বলেন, ‘বদলি বন্ধ থাকায় সারা দেশের শিক্ষকদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। আমরা এমনও খবর পেয়েছি যে বদলি হতে না পারায় অনেকের সংসারজীবনেও বিপর্যয় নেমে এসেছে। তাই আমরা অবিলম্বে বদলি কার্যক্রম শুরু করার জন্য কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’
বদলি হতে না পেরে বেশ কয়েক জন শিক্ষক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তেমনই একজন শিক্ষক শীলা আক্তার। তিনি লেখেন, ‘দেশে সব কার্যক্রম চলছে; শুধু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বদলি কার্যক্রম বন্ধ। শিক্ষকরা কতটা শারীরিক, মানসিক কষ্টে আছেন, তা ভুক্তভোগীরাই জানেন। কর্তৃপক্ষের প্রতি বিনীত আবেদন, দ্রুত বদলি চালু করুন, আমাদেরকে সুস্থভাবে বাঁচার সুযোগ দিন।’
অনলাইনে প্রাথমিক শিক্ষক বদলি কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ (আইএমডি)। এ বিভাগের অধীনেই তৈরি করা হয়েছে অনলাইনে বদলির সফটওয়্যার। জানতে চাইলে আইএমডি বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না পাওয়ায় শিক্ষক বদলি বন্ধ রয়েছে। আপাতত অনলাইনে শিক্ষক বদলি শুরু হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এর আগেও তিন দফায় পাইলটিংয়ের তারিখ পরিবর্তন করা হয়েছে।’ কেন তিন দফা উদ্যোগ নিয়েও অনলাইনে বদলির পাইলটিং শুরু করা যায়নি এমন প্রশ্নে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘মূলত মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েক জনের ব্যক্তিগত মতপার্থক্যের কারণেই বারবার পাইলটিং পিছিয়ে যাচ্ছে।’
প্রসঙ্গত, ২০২০ সাল থেকে প্রায় আড়াই বছর বন্ধ ছিল প্রাথমিকের শিক্ষক বদলি কার্যক্রম। ২০২২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ‘সমন্বিত অনলাইন বদলি নির্দেশিকা ২০২২’ জারি করে তৎকালীন সরকার। শিক্ষকদের ভোগান্তি রোধ ও দুর্নীতি রুখতে অফলাইন থেকে অনলাইনে বদলি আবেদন হলেও কোনো সুফল পাননি শিক্ষকরা। সব শর্ত পূরণ করেও বদলি হতে পারেননি অধিকাংশ শিক্ষক। আবার অর্থের বিনিময়ে শর্ত পূরণ না করেও বদলি হন এক শ্রেণির শিক্ষক। এক্ষেত্রে ঐসব শিক্ষকদের প্রত্যেকের ৫ লাখ থেকে ৭ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর প্রাথমিকের শিক্ষকরা আশায় বুক বেঁধেছিলেন যে, এবার হয়তো তারা বদলি সুবিধা পাবেন। কিন্তু তাদের সেই অপেক্ষা যেন আর শেষ হচ্ছে না।
এ ইউ/
Discussion about this post