মাতৃভূমি বাংলাদেশ থেকে শুরু করা যাত্রা ইউরোপে এসে শেষ হবে, এমন কথা ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি তারা৷ উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে লিবিয়ায় পাড়ি জমান বাংলাদেশি তরুণ সিয়াম ও মোহাম্মদ৷ কিন্তু লিবিয়া তাদের জন্য নরকে পরিণত হয়েছিল৷ অবস্থা এমন হয়েছিল, সেখান থেকে পালাতে পারলেই বুঝি মুক্তি৷ তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতেও পিছপা হননি তারা৷
২০ মে ভোরে ভূমধ্যসাগরের মাল্টা উপকূলে বিপদাপন্ন একটি নৌকায় থাকা ৩৫ বাংলাদেশিকে উদ্ধার করেছে উদ্ধারকারী জাহাজ ওশেন ভাইকিং৷ সেই নৌকাতেই ছিলেন এই দুই জন৷
উদ্ধারকারী জাহাজটিতে রয়েছেন বার্তা সংস্থা এএফপির এক সংবাদকর্মী৷ উদ্ধারের কয়েক ঘন্টা পর বাংলাদেশি দুই তরুণের সঙ্গে কথা হয় তার৷
২৫ বছর বয়সি মোহাম্মদ বলেন, ‘‘তারা (লিবিয়ার মানবপাচারকারীরা) আমার পায়ে আঘাত করেছে, মারধর করেছে এবং আমার শরীরেও অনেকবার ঘুষি মেরেছে৷’’
লিবিয়ার অস্ত্রধারী মানবপাচারকারীদের নৃশংস আচরণের বর্ণনা দেন মোহাম্মদ৷ ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে মোহাম্মদ বলেন, মাসের পর মাস ধরে তার বন্দি জীবনের কথা৷ মোহাম্মদকে যারা অপহরণ করেছিল, তারা ‘‘নখ উপরে ফেলার’’ হুমকি দিয়েছিল বলেও জানান তিনি৷
উপার্জন করে পরিবারের জন্য অর্থ পাঠাবেন, সংসারে স্বচ্ছ্বলতা ফিরবে—এমন স্বপ্ন নিয়েই লিবিয়া এসেছিলেন মোহাম্মদ৷ কিন্তু অভিজ্ঞতাটা মোটেই সেরকম ছিল না৷ সেই তরুণ বললেন, ‘‘আমি যদি এখানে (লিবিয়া) থাকি, আমি নিশ্চত মারা যাব৷’’
কালো চুলে ভরে আছে মোহাম্মদের মাথা৷ চুলগুলো বেশ লম্বা হয়েছে৷ অযত্নের ছাপ স্পষ্ট বোঝা যায়৷ তার চোখ জোড়া গোল এবং ডাগর৷ জাহাজের ডেকে বসে দিগন্ত রেখায় দৃষ্টি রেখে কী যেন ভাবছিলেন তিনি৷ নিজের অজান্তে পরনে থাকা ট্রাকসুটের জিপারটি উঠা-নামা করছিলেন তিনি৷
তিনি বলেন, ‘‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম, যাই ঘটুক না কেন, এই জায়গা আমাকে ছাড়তেই হবে৷’’
২০ বছর বয়সি আরেক বাংলাদেশি তরুণ সিয়াম বললেন, ‘‘যদি আপনি টাকা দিতে পারেন, তাহলে আপনি মুক্তি পাবেন৷ নয়তো অনেক মারধর করে তারা৷’’
তিনি আরো বলেন, মানবপাচারকারীরা ‘‘যখন আমাদের মারধর করতো, সেটা ভিডিও করতো৷ সেই ভিডিও আমাদের পরিবারে পাঠিয়ে টাকা চাওয়া হতো৷ আর বলতো, টাকা না পাঠালে তারা আমাদের মেরে ফেলবে৷’’
কয়েকশ ইউরো খরচ করে বিমানের টিকিট কিনে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে লিবিয়ায় এসেছিলেন তারা দুই জন৷ আশা ছিল কৃষি, তেল বা নির্মাণ খাতে চাকরি পাবেন তারা৷ অবশ্য কেউ কাউকে চিনতেন না৷ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়ার সময় তাদের দেখা হয়েছিল৷
২০১১ সাল থেকে বিশৃঙ্খলাপূর্ণ লিবিয়ায় এসে দেখলেন, যেমন ভেবেছিলেন পরিস্থিতি তেমন নয়৷ চাকরির পরিবর্তে অভিবাসী বাণিজ্যের ফাঁদে পড়েছিলেন তারা৷
দুই তরুণেরই বাবা বেঁচে নেই৷ তাই পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব বর্তায় তাদের কাঁধে৷
মোহাম্মদ বলেন, ‘‘সবাই আমার উপর নির্ভর করে আছেন—চিকিৎসা, খাবারসহ সবকিছুতেই আমার উপর নির্ভরশীল তারা৷’’
এক মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে বেনগাজি হাসপাতালে ক্লিনার বা পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসাবে কাজ পেয়েছিলেন সিয়াম৷ তিনি বলেন, ‘‘কিন্তু আমাকে বেতনের অর্ধেক দেয়া হয়েছিল৷ যখন আমি আমার পাওনা চেয়েছিলাম, তখন আমাকে তারা চড় মেরেছিল৷’’
এমন পরিস্থিতিতে পালানোই একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়াল তাদের সামনে৷ কিন্তু জীবনের ঝুঁকি নিয়েও বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক অভিবাসন রুট পাড়ি দিতে গুণতে হবে পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি থাকায় পাঁচ লাখ টাকারও বেশি৷ কিন্তু এই টাকা যোগাড় করা কিভাবে সম্ভব?
বাধ্য হয়ে পরিবারের কাছেই হাত পাতলেন সিয়াম৷ তিনি জানালেন, ‘‘আমার পরিবার বাড়ি বিক্রি করে দেয়৷ আমাকে বাঁচাতেই বাড়ি বিক্রি করতে হয়েছে৷’’
দীর্ঘদিন অস্বাস্থ্যকর, দমবন্ধ হওয়ার মতো এক ভবনে আটকে রাখার পর এক পাচারকারী মোহাম্মদকে অন্য এক পাচারকারীর হাতে তুলে দেয়৷ সেখান থেকেই দুই সঙ্গীসহ পালাতে পেরেছেন তিনি৷ তখন মাথার উপর নেই কোনো ছাউনি, পকেটে নেই কোনো টাকা৷
নানা কাঠখড় পোহানোর পর অবশেষে একটি ফাইবার গ্লাসের নৌকায় উঠতে পারলেন মোহাম্মদ৷ সেখানেই দেখা হলো সিয়ামের সঙ্গে৷ তাদের গন্তব্য ছিল ইটালির সিসিলি৷
নৌকার নিচের অংশে ছিলেন তারা৷ ঠান্ডা পানিতে গোসল করার দুঃসহ অভিজ্ঞতা, বাতাসে ছড়িয়ে পড়া গ্যাসোলিনের উৎকট গন্ধের মধ্যে কাঠানো সময় তাদের তাড়া করছিল তখনও৷
মোহাম্মদ বলেন, ‘‘সমুদ্রে খুব বড় বড় ঢেউ ছিল, উচ্চতা কমপক্ষে পাঁচ-ছয় মিটার হবে৷ সেই তুলনায় নৌকাটি খুব ছোটো ছিল৷’’
রওনার হওয়ার সময় থেকে পরের তিন দিনে ছয়শ কিলোমিটার (৩৭০ মাইল) পাড়ি দিয়েছেন তারা৷ এরপর খাবার, পানি, জ্বালানি সব ফুরিয়ে যায়৷ ওই সময় নৌকাটিতে পানি উঠতে শুরু করে৷ খালি বোতল, স্পঞ্জ, কাপড়—সবকিছুই ব্যবহার করেছেন তারা নৌকার ফুটো বন্ধ করতে৷
শেষ পর্যন্ত অ্যালার্ম ফোনের সঙ্গে যোগাযোগ হয় তাদের, জানাতে পারেন সাগরে নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে৷ ভূমধ্যসাগরে বিপদাপন্ন নৌকাগুলো শনাক্ত করার হটলাইন হলো অ্যালার্ম ফোন৷
সোমবার ভোররাত চারটার দিকে এসওএস মেডিটেরানের উদ্ধারকারী জাহাজ ওশেন ভাইকিং তাদের উদ্ধারে অভিযান শুরু করে৷
ওশেন ভাইকিং জাহাজটিকে দেখে প্রথমে জলদস্যু ভেবে ভয় পেয়েছিলেন মোহাম্মদ৷ তখন তিনি ভাবছিলেন, ‘‘কিন্তু তারা আমাদের কাছ থেকে কী নিতে পারে? আমাদের তো দেয়ার মতো আর কিছুই নেই৷’’
ক্লান্ত বিধ্বস্ত ৩৫ বাংলাদেশিকে একে একে উদ্ধার করে জাহাজে নিয়ে আসেন উদ্ধারকর্মীরা৷
ওশেন ভাইকিংয়ের উদ্ধারকর্মীদের সিয়াম বলেন, ‘‘আপনারা আমাদের জন্য আশীর্বাদ… আপনারা আমাদের খুব ভালবাসেন, তাই আমাদের জীবন বাঁচিয়েছেন৷’’
ইটালি পৌঁছে আশ্রয়ের জন্য আবেদন করতে চান এই দুই বাংলাদেশি৷ কিন্তু ইটালির ডানপন্থি প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনির শাসনামলে বিষয়টি কঠিন হতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে৷
কারণ চলতি মাসেই বাংলাদেশকে নিরাপদ দেশ হিসাবে মনোনীত করেছে ইটালি৷ একটি ‘নিরাপদ দেশ’ হিসাবে বাংলাদেশ থেকে আসা আশ্রয়প্রার্থীদের আশ্রয় আবেদন মঞ্জুর করার বিষয়টি মোটেও আর সহজ হবে না৷ বেকারি বা প্রেস্ট্রি শেফ হওয়ার স্বপ্ন দেখা মোহাম্মদ এই কথা শুনে খুবই হতাশ হয়ে পড়েন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি মৃত্যুর খুব কাছে থেকে ফিরেছি, এখানে থাকাটা আমার জন্য দ্বিতীয় জন্ম৷ সূত্র: ইনফোমাইগ্রেন্টস
Discussion about this post