বিশ্বে অর্থনৈতিক মানচিত্রে দুইটি তত্ত্ব দীর্ঘদিন যাবৎ প্রতিষ্ঠিত। পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র। নানা কারণে এখন আর সমাজতন্ত্র আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নেই। পুঁজিবাদ বিরাজ করছে পৃথিবী জুড়ে। সেই পুঁজিবাদ আজ নানা সংকট ও প্রশ্নের সম্মুখীন। বিশ্বের ধনবাদী দেশগুলো এখন আর সনাতন পুঁজিবাদে সন্তুষ্ট নয়। অনেকে মনে করেন পুঁজিবাদের একটা সংস্কার হওয়া দরকার। এ রকম বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ক্ষুদ্র ঋণের উদ্ভাবক গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা নোবেলবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছেন তার সাম্প্রতিক সামাজিক ব্যবসায় তত্ত্ব। এই ব্যবসায়ে বিনিয়োগকারীরা একটা সামাজিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বিনিয়োগ করবেন, কিন্তু সেই ব্যবসায় থেকে মুনাফা গ্রহণ করবেন না।
একই সঙ্গে দেশে বিরাজমান নানা সমস্যার সমাধান করা হবে। এবং সেটা অনুদান বা চ্যারিটির ভঙ্গিতে নয়, সম্পূর্ণ ব্যাবসায়িক ভঙ্গিতে। ব্যবসায় দিয়ে যে মানবজাতির সেবা করা যায়, সেটার দৃষ্টান্ত সামাজিক ব্যবসায়। এখন প্রশ্ন হলো ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জন বা মুনাফার স্বার্থ না দেখে এই স্বার্থহীন লক্ষ্য স্থির করে কেউ কি সামাজিক ব্যবসায় চালু করতে আগ্রহী হবেন? সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগের টাকাটা কোথা থেকে আসবে? কে পুঁজি বিনিয়োগে আগ্রী হবে? বিনিয়োগের টাকা সব স্তরের মানুষের কাছ থেকেই আসতে হবে, যেহেতু তারা স্বার্থহীন সামাজিক ব্যবসায় চালু করে সার্বিক মানসিক সন্তুষ্টি/তৃপ্তি অর্জন করবেন।
সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগকারীরা শুধু টাকাই বিনিয়োগ করবেন না, তাদের সৃষ্টিশীলতা, যোগাযোগের দক্ষতা, প্রযুক্তিগত মেধা, জীবনের অভিজ্ঞতাসহ অনেক কিছুই বিনিয়োগ করে পৃথিবীটাকে পালটে দিতে পারেন। সামাজিক ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে সাতটি মূলনীতি বিবেচনায় থাকতে হবে, তাহলে তাকে সামাজিক ব্যবসায় বলা যাবে। যেমন: (ক) দারিদ্র্য বিমোচনসহ এক বা একাধিক বিষয়, যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি ও পরিবেশগত খাতে বিরাজমান সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিগত মুনাফাহীন কল্যাণকর ব্যবসায় এটি। (খ) সবার সক্ষমতা অর্জন করাই এ ব্যবসায়ের লক্ষ্য। (গ) সামাজিক ব্যবসায় বিনিয়োগকারীরা শুধু তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থই ফেরত পাবে, এর বাইরে কোনো লভ্যাংশ নিতে পারবে না। (ঘ) বিনিয়োগকারী তার বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত নেওয়ার পর বিনিয়োগকৃত অর্থের মুনাফা কোম্পানির সম্প্রসারণ কাজে ব্যবহৃত হবে। (৬) এ বাবসায় হবে পরিবেশবান্ধব। (চ) এখানে যারা কাজ করবেন তারা ভালো কাজের পরিবেশ ও চলমান বাজার অনুযায়ী বেতন- ভাতা পাবেন। (ছ) সামাজিক ব্যবসায় হবে আনন্দের সঙ্গে ব্যবসায়।
প্রচলিত ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠানের মূল্যায়নের চাবিকাঠি উত্তর উত্তর মুনাফা অর্জন। যে প্রতিষ্ঠান বেশি মুনাফা করে, তার প্রতি সবার আকর্ষণও বেশি থাকে। তাদের ব্যবসায়- প্রতিষ্ঠানকে ‘সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনকারী প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এদের মধ্যে মুনাফা বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা হয়ে থাকে। অন্যদিকে সামাজিক ব্যবসার কোম্পানিগুলো নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করবে, কোন ব্যবসায়ী কত দক্ষতার সঙ্গে সমাজের সমস্যা সমাধান দিতে পারে, তার ওপর নির্ভর করবে প্রতিযোগিতার সাফল্য। যদি একই বাজারে দুই বা ততোধিক সামাজিক ব্যবসায় কোম্পানি পরিচালনা করে, তাহলে সেটা গ্রাহক ঠিক করবে কোন কোম্পানিকে তারা বেছে নেবে।
যখন দুইটি সামাজিক ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগকারী পেতে প্রতিযোগিতায় নামে, তাদের ঐ প্রতিযোগিতা সর্বাধিক ভবিষ্যৎ মুনাফা করার ভিত্তিতে হয় না। প্রতিযোগিতা হয় কে কী পরিমাণ সামাজিক উপকার নিশ্চিত করতে পারবে তার ভিত্তিতে। প্রথম ধরনের সামাজিক ব্যবসায় হলো মালিকের জন্য সর্বোচ্চ মুকফা করার পরিবর্তে সামাজিক উপকার সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে স্বাস্থ্য পরিচর্যা, সামাজিক ন্যায়বিচার, টেকসই প্রযুক্তি এবং পরিবেশ উন্নয়ন ইত্যাদি লক্ষ করে এসব ব্যবসায় গড়ে উঠবে। এ ব্যবসায়ে বিনিয়োগকারীরা আর্থিক দিক দিয়ে পুরস্কৃত হওয়ার চেয়ে আত্মিক সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দেবে। এ ব্যবসায়ের ধারাই সামাজিক উন্নয়ন সুদৃঢ় হবে।
এখন দুইটি সামাজিক ব্যবসায়ের মধ্যে পার্থক্যগুলো লক্ষ করুন। প্রথম ধরনের সামাজিক ব্যবসায়ের বেলায় পণ্য সেবা বা ব্যবসায়ের পরিচালনা পদ্ধতির প্রকৃতিই সমাজকল্যাণ সাধন করে। এ ধরনের ব্যবসায় পরিবেশকে দূষণমুক্ত করতে পারে, সামাজিক বৈষম্য কমাতে পারে, মাদকাসক্তি, পারিবারিক সহিংসতা, বেকারত্ব বা অপরাধ হ্রাস বা উপশমে কাজ করতে পারে।
দ্বিতীয় ধরনের সামাজিক ব্যবসায়ের আওতায় যেসব পণ্য সামগ্রী বা সেবা উৎপাদিত হয়, তাকে অন্য কোনো পণ্য বা সেবা থেকে আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। এ ধরনের কোম্পানি সামাজিক উপকার তৈরি করে শুধু গরিব মানুষকে ব্যবসায়ের এবং সম্পদের মালিক বানিয়ে দিয়ে। যেমন গ্রামীণ ব্যাংক গরিবদের স্বল্প সুদে ক্ষুদ্রাকারের ঋণ দেয়, যাতে তারা ছোটখাটো ব্যবসায় করতে ও শেষ পর্যন্ত নিজেদের দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে মুক্ত করতে পারে। যদি ধনীরা এই ব্যাংকের মালিক হতো, তাহলে গ্রামীণ ব্যাংক রীতিমতো একটা সর্বোচ্চ মুনাফাকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতো। কিন্তু তা হয়নি। গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক ঋণগ্রহীতারা ৭৫ শতাংশ। মালিকরা লভ্যাংশের ভাগ পায়। ব্যাংক পরিচালনা বোর্ডে ১৩ জন পরিচালকের মধ্যে ১ জন গ্রামীণ ব্যাংকের এই গরিব সদস্যরা। এরাই ব্যাংকের নীতিনির্ধারক। এদের মালিক করার কারণেই ব্যাংকিং কার্যক্রমে স্বচ্ছতা সর্বক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়। বর্তমানে এই ব্যাংকের ঋণের আদায় হার ৯৭ শতাংশ গ্রামীণ ব্যাংকের আদলে বিশ্বের ৯৭টি দেশে এর কার্যক্রম চলছে। গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম কীভাবে চলছে, তা দেখতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাংবাদিক, গবেষক, রাষ্ট্রের প্রতিনিধি, এবং ছাত্রছাত্রীরা গ্রামীণ ব্যাংকে আসেন। এটা এ দেশের জন্য খুবই গর্বের বিষয়। সামাজিক ব্যবসায়ের ধরন দেখে মুগ্ধ হয়ে বিশ্বের ৮০টি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে সোশ্যাল বিজনেস ইউনূস সেন্টার চালু করেছে।
বার্লিনে ২০১৫ সালে বিশ্বের প্রায় ৭০টি দেশ থেকে সহস্রাধিক বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বা এসডিজির লক্ষ্যমাত্রাগুলো পূরণে কীভাবে সামাজিক ব্যবসায়ে ভূমিকা রাখতে পারে, তার পথ খুঁজে বের করাই ছিল এ সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য। বর্তমানে ড. মুহাম্মদ ইউনুস দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে সামাজিক ব্যবসায়ের এই নতুন তত্ত্বটি নিয়ে পৃথিবীব্যাপী কাজ করে যাচ্ছেন। সামাজিক ব্যবসায়ের এই ধারণাটি পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশ ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে।
সোশ্যাল বিজনেসের সম্মেলন এখনো বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিকভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করে থাকে। দিনদিন সোশ্যাল বিজনেস জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। অনেক দেশেই সামাজিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা করে সামাজিক বৈষমা, বেকারত্ব দূর করতে সক্ষম হয়েছে। যদি বাংলাদেশে সামাজিক ব্যবসায়ের বাস্তবায়ন করা যায় ভোক্তা অধিকার বাস্তবায়ন হবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করা যাবে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
লেখক: ব্যাংকার ও কলামিস্ট
এম এইচ/
Discussion about this post