জাতিসংঘ পশ্চিম সাহারা রেফারেন্ডাম মিশনের ফরাসি সংক্ষিপ্ত নাম মিনারশো (এমআইএনইউআরএসও)। এ মিশনে একজন সামরিক পর্যবেক্ষক হিসেবে ২০০৪ সালের ৮ অক্টোবর পশ্চিম সাহারার লেউন শহরে পৌঁছাই। বাংলাদেশ থেকে আটজন সামরিক পর্যবেক্ষকের মধ্যে আমি ছিলাম জ্যেষ্ঠতম।
প্রথম এক সপ্তাহ লেউন শহরে মিনারশো সদরে ওরিয়েন্টশন ও ড্রাইভিং টেস্টে উত্তীর্ণ হওয়ার পর পশ্চিম সাহারার নর্দার্ন সেক্টরে অবস্থিত টিম সাইট বীরলালুতে যোগদান করি। এটা তাঁবু খাটানো ক্যাম্প। বিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে। প্রতি টিম সাইটে ১০-১২ দেশের সামরিক পর্যবেক্ষক ১৬ থেকে ২০ জন দায়িত্বে থাকেন। সাহারা আরবি শব্দ। বাংলা অর্থ হলো মহান মরুভূমি। এই মরুভূমিতে তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস ছাড়াও তামা, লোহা, ফসফরাসসহ অন্যান্য মূল্যবান খনিজদ্রব্য আছে।
এখানে দিনে প্রচণ্ড গরম আর রাতে ঠান্ডা। অধিকাংশ মানুষ বেদুইন। তাঁরা ছাগল, ভেড়া ও উট পালন করেন। মরুভূমির কোনো কোনো জায়গায় ঘাস, গুল্ম ও ছোট গাছ জন্মে। সাপ, গিরগিটি ও খ্যাঁকশিয়ালের মতো প্রাণী বাস করে এখানে। যাতায়াতের জন্য উট ব্যবহার করা হয়। গ্রীষ্মকালে প্রায়ই ধূলিঝড় হয়। দুপুরে দেখা যায় মরীচিকা!
টিম সাইট বীরলালুতে চার মাস দায়িত্ব পালন করার পর লেউন শহরে মিনারশো সদরে ডেপুটি লজিস্টিক অফিসার, পরবর্তী সময়ে চিফ লজিস্টিক অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। ৫ এপ্রিল ২০০৫ তারিখে অপারেশন অফিসার ও একজন নাইজেরিয়ান মেজর আমাকে ফোনে জানান, ৪৬ জন বাংলাদেশি পশ্চিম সাহারার সারাউয়ি পিপলস লিবারেশন আর্মির (মুক্তিবাহিনী) হাতে আটক হয়ে টিফারিতি ক্যাম্পে অবস্থান করছেন। এই তথ্য নিউইয়র্ক জাতিসংঘ সদরে পৌঁছায়।
আমি তাঁদের কাছ থেকে জানতে পারি, কীভাবে তাঁরা এই সীমাহীন মরুভূমিতে এসে পৌঁছান। তাঁরা সবাই ১০-১২ লাখ টাকা খরচ করে ছোট ছোট দলে ঢাকা-সংযুক্ত আরব আমিরাত-মালি-মৌরিতানিয়া হয়ে পশ্চিম সাহারায় পৌঁছান। তাঁরা কেউ বাড়ি থেকে ৪ মাস, কেউ আবার ১২ মাস আগে বের হন।
আমি এ সংবাদে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়ি। আমি একই তথ্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর এবং মরক্কোর রাজধানী রাবাতে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনকে ই-মেইলের মাধ্যমে জানাই। বন্দী অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সাহায্য করার জন্য চেষ্টা চালাতে থাকি।
মিনারশো সদরের চিফ অপারেশন অফিসার ঘানার একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল আমাকে জানান যে, ওই বাংলাদেশিদের উদ্ধার এবং প্রত্যাবর্তনের দায়িত্ব মিনারশোর ম্যান্ডেটে নেই। মিনারশো সদর এই সীমাবদ্ধ এলাকায় তথ্য আদান–প্রদান করতে পারে মাত্র। ঘটনার স্থান এমনই যে সেখানে সারাউয়ি পিপলস লিবারেশন আর্মি বা মিনারশো সামরিক পর্যবেক্ষক ছাড়া অন্য কেউই যেতে পারে না।
ইতিমধ্যে তিন্দুফ, আলজেরিয়া থেকে মিনারশো সদরে অস্থায়ী স্পেশাল রিপ্রেজেনটেটিভ অব সেক্রেটারি জেনারেলের (এসআরএসজি) দায়িত্ব পালন করতে ইনগুন্দে ফুউলাও নামের একজন জার্মান ভদ্রমহিলা আসেন। আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করে আটকে পড়া বাংলাদেশিদের উদ্ধারে সাহায্য কামনা করি। আমি তাঁরই অনুমতিক্রমে প্রথমে এএন ৩২ উড়োজাহাজে, পরবর্তী সময়ে এমআই ১৬ হেলিকপ্টারে করে টিম সাইট টিফারিতিতে পৌঁছাই।
বাংলাদেশি ভাইদের জন্য খাবার, ফল ও পানীয় নিয়ে যাই। সেখানে ৪৬ বাংলাদেশির নাম ও ঠিকানা সংগ্রহ করি। তাঁদের মধ্যে কারও কারও মধ্যপ্রাচ্যে চাকরির অভিজ্ঞতা ছিল এবং আরবি ভাষায় কথা বলতে পারতেন। তাঁরা সারা দিন টিফারিতি মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পে কাজ করতেন এবং সেই ক্যাম্প থেকে এক বেলা রুটি ও ডাল খাবার পেতেন।
আমি তাঁদের কাছ থেকে জানতে পারি, কীভাবে তাঁরা এই সীমাহীন মরুভূমিতে এসে পৌঁছান। তাঁরা সবাই ১০-১২ লাখ টাকা খরচ করে ছোট ছোট দলে ঢাকা-সংযুক্ত আরব আমিরাত-মালি-মৌরিতানিয়া হয়ে পশ্চিম সাহারায় পৌঁছান। তাঁরা কেউ বাড়ি থেকে ৪ মাস, কেউ আবার ১২ মাস আগে বের হন। তাঁদের গন্তব্যস্থল ছিল ইউরোপ।
তাঁরা পশ্চিম সাহারা অতিক্রম করে মরক্কোয় প্রবেশ করলে সেখানকার সেনাবাহিনী তাঁদের আটক করে এবং পশ্চিম সাহারার সারাউয়িদের পাশে পুশব্যাক করে। তাঁরা সারাউয়ি পিপলস লিবারেশন আর্মির হাতে ধরা পড়েন এবং টিফারিতি সারাউয়ি পিপলস লিবারেশন আর্মি (মুক্তিবাহিনী) ক্যাম্পে তাঁদের বন্দী করে রাখে।
তাঁরা সবাই আমাকে ইউরোপে পৌঁছানোর জন্য সহযোগিতা করতে অনুরোধ জানান। আমি তাঁদের জানিয়ে দিই যে আমি তাঁদের বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য চেষ্টা করতে পারি এবং সারাউয়ি পিপলস লিবারেশন আর্মিকে অনুরোধ করতে পারি, যেন তাঁরা ভালো আচরণ করে। যাহোক পরে প্রত্যাবাসন ছাড়া কোনো পথ ছিল না।
আমি এসব যুবকের হাতে লেখা চিঠি স্ক্যান করে ঢাকায় অবস্থিত আমার বন্ধুর কাছে পাঠিয়ে বলি, সে যেন ওই চিঠিগুলো প্রিন্ট করে চিঠির ওপর উল্লেখিত ঠিকানায় পাঠিয়ে দেয়। আমি তাদের জন্য বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে মাঝেমধ্যে খাবার সংগ্রহ করে পাঠাতাম। অনেকের জন্য দেশ থেকে কাপড় ও টাকা সংগ্রহ করে পাঠাই।
জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমি ছুটি নিয়ে জেনেভায় যাই। সেখানে জাতিসংঘের বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন অফিসে যাই। বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করে পরিস্থিতি বর্ণনা করি। পরবর্তী সময়ে সদর দপ্তর আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম), জেনেভা এবং আঞ্চলিক আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা অফিস ঢাকায় যোগাযোগ রক্ষা করি।
আমি ভলান্টারি রিটার্ন অ্যাসিস্ট্যান্স ফরম সংগ্রহ করি। এরপর টিফারিতি ক্যাম্পে পৌঁছাই। সেখানে ৪৬ জন অভিবাসনপ্রত্যাশীর ফরম পূরণ করি। অন্যদিকে আলজেরিয়ার তিন্দুফ ক্যাম্প থেকে ইনগুন্দে ও পিটার টিফারিতিতে পৌঁছান। পিটার একজন কানাডিয়ান কর্মকর্তা। তিনি তিন্দুফে কর্মরত ছিলেন। তিনি তাঁর ডিজিটাল ক্যামেরা দিয়ে সবার ছবি তোলেন, প্রিন্টার দিয়ে প্রিন্ট করেন। সবার জন্য চার সেট কাগজ তৈরি করা হয়।
পরদিন আমরা টিফারিতি ক্যাম্প ত্যাগ করি। ইনগুন্দের সহায়তায় সব ফরম ও কাগজ সেনেগালের রাজধানী ডাকারে আইওএম আঞ্চলিক অফিসে পাঠাই। এসব কাজ আইওএম কর্মকর্তার করার কথা ছিল; কিন্তু আমরা বিশেষ পরিস্থিতি ও মানবিক কারণে সেই কাজগুলো করি।
আমার দায়িত্ব ২০০৫ সালের ১৫ অক্টোবর শেষ হয়। ১৭ অক্টোবর দেশে ফিরি। ইনগুন্দের সঙ্গে মেইলে যোগাযোগ রাখি। তিনি ২০০৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর আমাকে ই-মেইল করেন। তাঁর বাংলা অনুবাদ এমন ‘১৪ জানুয়ারি ২০০৬ তারিখে সবাইকে জরেটে হস্তান্তর করা হবে এবং তাঁরা ২০০৬ সালের ১৫ অথবা ১৬ জানুয়ারি মৌরিতানিয়া থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হবেন। যত্ন নিও। ইনগুন্দে।’
বন্দী অবস্থা থেকে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের উদ্ধার করে বাংলাদেশে ফেরত আনতে প্রায় ১০ মাস সময় লাগে। আমি পত্রপত্রিকায় পড়েছি এবং টেলিভিশনে খবরে দেখেছি, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে কীভাবে ইউরোপে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সাগরে সলিলসমাধি হয়েছে। সেই ৪৬ জন অভিবাসনপ্রত্যাশীর প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা না হলে তাঁদের ভাগ্যে কী ঘটত তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন!
লেখা:শেখ মাসুমুল হাসান, সাবেক সেনা কর্মকর্তা
সূত্র – প্রথমআলো
এ এস/
Discussion about this post