১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর সপ্তম নৌবহরের বঙ্গোপসাগরে অফিসিয়াল যাত্রা শুরুর পর ১৩ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন সপ্তম নৌবহরকে ঠেকাতে ঘোষণা দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রক্তের স্রোতধারায় যে ঢেউ তরীগুলো ভাসিয়েছিল, সেই তরীগুলো বহমান রক্তাক্ত সাগর-মহাসাগর পেরিয়ে চরম উত্তেজনা তৈরি করেছিল কিউবাতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবী প্রায় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাছাকাছি ছিল কিউবান মিসাইল ক্রাইসিসের মাধ্যমে।
সত্য গোপন যেমন মিথ্যার চেয়ে জঘন্য, ঠিক এর চেয়ে কঠিনতর জঘন্য হলো ইতিহাস গোপন; যা ইতিহাস বিকৃতি থেকেও প্রচণ্ড ঘৃণ্য। সোভিয়েতের জন্মই হয়েছিল অত্যাচারের বিরুদ্ধাচরণ করে। সমস্ত নির্যাতিত অধিকারহীনদের চেতনা এদের মননে মগজ। সেই ১৯৪০ দশকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য যখন ভারতীয় উপমহাদেশকে ধর্মীয় সর্বসংহারে ব্যবহার করে দ্বিখণ্ডিত করেছিল তারা তখনও এর বিপক্ষে ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্নায়ুযুদ্ধ চরম পর্যায়ে চলে যায়। একদিকে ন্যাটো জোট চাপ, অন্যদিকে চীন-সোভিয়েত সীমান্ত দ্বন্দ্ব। ন্যাটো জোটের বিপক্ষে পোলান্ডের ওয়ারশ ট্রিটি অর্গানাইজেশন গঠিত হয়। অন্যদিকে চীন-ভারত যুদ্ধ, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, এদিক থেকে চীন-পাকিস্তান বন্ধুত্ব হয় ভারতের বিরুদ্ধে আর পাকিস্তানের তৎকালীন সবচেয়ে পরম বন্ধু ছিল যুক্তরাষ্ট্র। ভারত সোভিয়েতের দিকে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য হাত বাড়ায়। ১৯৫০ দশকে পাকিস্তানকে সোভিয়ত ইউনিয়ন সংজ্ঞায়িত করেছিল:- “Pakistan as an ‘artificial’ state, a geographical absurdity with it’s two wings”.
বিশ্বে নিজ নিজ প্রভাব বলয়ের স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ভারতীয় উপমহাদেশে তখন পরস্পর বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে। আর ১৯৭১ সালেও তা পূর্বনির্ধারিত একই রূপ ধারণ করে। সালাহউদ্দিন আহমেদের “বাংলাদেশ পাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্ট” বইয়ের ৩৪৭ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “ষাটের দশকের শেষ নাগাদ ক্রেমলিন এই উপসংহারে পৌঁছেছিল যে,পাকিস্তানের পশ্চিমাংশ থেকে পূর্বাংশের বিচ্ছিন্নতা সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের স্বার্থের অনুকূল হবে।” ১৯৭০ সালে ওয়াশিংটন সফরকালে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্ব আরও অটুট হয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে ক্রেমলিন-দিল্লি ১৯৭১ সালে সোভিয়েত-ভারত ২০ বছর মেয়াদী মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আর চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কারণে ভারতের মনোবল বৃদ্ধি পায়।
এই চুক্তির ৯ নাম্বার অনুচ্ছেদে বলা আছে- “সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো কোনো পক্ষের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘাতে জড়িত তৃতীয় কোনো পক্ষকে কোনো ধরনের সহায়তা প্রদানে বিরত থাকবে। চুক্তিতে স্বাক্ষরদানকারী কোনো পক্ষ আক্রান্ত হলে অথবা হুমকির মুখোমুখি হলে পক্ষগুলো তাদের নিজ নিজ দেশের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে এ ধরনের হুমকি দূর করতে এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে অবিলম্বে পারস্পরিক আলোচনায় মিলিত হবে।” আর চুক্তির মূলই পাকিস্তানকে মোকাবিলা আর বিশেষভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিহত করার সামরিক চুক্তি, যার মাধ্যমে ভারতে অখণ্ডতা রক্ষার জন্য সোভিয়েত সরাসরি যুদ্ধনীতি অবলম্বন করতে পারবে।
এই চুক্তির পর ইন্দিরা গান্ধী এক শক্তিশালী রূপে আবির্ভূত হন। যুক্তরাষ্ট্র সফরে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে কথা বলতেই রেগে চটে যান প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ওপর এবং বৈঠক বাতিল করে চলে আসেন।
হেনরি কিসিঞ্জার তখন বলেন, “আরেকটু ধৈর্য্য দেখানো উচিত ছিল।” সোভিয়েত এই ঘটনার পর পরই ভারত মহাসাগরে শুভেচ্ছা সফরে একটি মাইনসুইপার জাহাজ, একটি ডেস্ট্রয়ার, একটি ব্যাটল ট্যাংক ক্যারিয়ার জাহাজ ও একটি সাবমেরিন রেখেছিল যা পরবর্তীতে সপ্তম নৌবহরকে বিতারিত করার দূরদর্শী পদক্ষেপ ছিল। আর বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম যখন বিশ্ব নেতৃত্বের কাছে সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতি সাহায্য চান সোভিয়েত তখন বাংলাদেশকে ভারতের মাধ্যমে বৈষয়িক ও কূটনৈতিক সমর্থন প্রদান করে। ভারতে সামরিক সহায়তা প্রেরণ এবং জাতিসংঘে ভারতকে কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে পাকিস্তানের ব্যবচ্ছেদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সোভিয়েত ১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের সর্মথনপুষ্ট যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রস্তাবে ভেটো প্রয়োগ করে। যুক্তরাষ্ট্র এ প্রস্তাবে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি (গৃহযুদ্ধ), সশস্ত্র বাহিনী প্রত্যাহার এবং পাক-ভারত সীমান্তে পর্যবেক্ষক মোতায়নের প্রস্তাব করে। ঠিক একইভাবে ৬ ডিসেম্বর, ৮ ডিসেম্বর, ১৩ ডিসেম্বর ভেটো প্রয়োগ করে। আর ১০ ডিসেম্বর “Independent Republic Of Bangladesh”-কে সমর্থন করেন এবং বাংলাদেশের মানুষের উপর সামরিক জান্তার আক্রমণ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতারকে Out-Law বলে স্পষ্ট বিবৃতি দেয়। ৫ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘকে ব্যবহার করে− পাকিস্তানের পক্ষে সামরিক শক্তি প্রয়োগের হুমকি দেয়।
কিন্তু রাশিয়ার বিরোধিতায় ব্যর্থ হয়ে একতরফা শক্তি প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত নেয় যুক্তরাষ্ট্র। ৯ ডিসেম্বর তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের দিকে রওনা হতে নির্দেশ দেন। ১০ ডিসেম্বর সপ্তম নৌবহরের ১০টি জাহাজ নিয়ে “টাস্কফোর্স ৭৪” গঠন করা হয়। ১০ ডিসেম্বর এই নৌবহর মালাক্কা প্রণালীতে অবস্থান নেয়।
ভারত মহাসাগরে শুভেচ্ছা সফরে একটি মাইনসুইপার জাহাজ, একটি ডেস্ট্রয়ার, একটি ব্যাটল ট্যাংক ক্যারিয়ার জাহাজ ও একটি সাবমেরিন রেখেছিল। এছাড়া ৫ ডিসেম্বর আরও একটি মাইনসুইপার জাহাজ ও একটি ডেস্ট্রয়ার ভারত মহাসাগরে পৌঁছায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ৬টি জাহাজকেই বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি থাকার নির্দেশ দেয়। ৭ ডিসেম্বর ভ্লাদিভস্তক থেকে ১টি নিউক্লিয়ার বোমাবাহী মিসাইলসহ ব্যাটলক্রুজার, ও একটি নিউক্লিয়ার সাবমেরিন রওনা দেয়।
১০ ডিসেম্বর সপ্তম নৌবহরের বঙ্গোপসাগরে অফিসিয়াল যাত্রা শুরুর পর ১৩ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন সপ্তম নৌবহরকে ঠেকাতে ঘোষণা দেয়। তারা আগের জাহাজগুলোর সঙ্গে আরেকটি অ্যান্টি-ক্যারিয়ার টাস্কফোর্স পাঠাচ্ছে- যাতে আছে আরও একটি নিউক্লিয়ার বোমাবাহী মিসাইলসহ ব্যাটলক্রুজার, একটি নিউক্লিয়ার গাইডেড মিসাইল সাবমেরিন, একটি নিউক্লিয়ার অ্যাটাক সাবমেরিন এবং একটি ডেস্ট্রয়ার।
সপ্তম নৌবহর ১৪ ডিসেম্বর মালাক্কা প্রণালী অতিক্রম করে, বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে। ১৫ ডিসেম্বর সপ্তম নৌবহরের বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধজাহাজ নিয়োগ করে। এই দিন ২০টি সোভিয়েত রণতরী ভারত মহাসাগরে অবস্থান নেয়। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে অংশ নেওয়া থেকে নিজেদের বিরত রাখার সিদ্ধান্ত নেয় এবং সপ্তম নৌবহর ফিরিয়ে নেয়।
আমরা অনেকে বলে থাকি সোভিয়েতের অষ্টম নৌবহরে যুক্তরাষ্ট্র পিছু হটতে বাধ্য করেছিল। যা ছিল মিসাইল ক্রাইসিস পরে সবচেয়ে উল্লেখ্য ঘটনা এবং সোভিয়েত এই স্নায়ু যুদ্ধে জয়ী হয়েছিল কিন্তু ১৫ ডিসেম্বর শেষ পেরেকটি পাকিস্তানের কফিনে ঢুকিয়ে দেয় সোভিয়েত, যা ছিল সোভিয়েতের সবচেয়ে তৎকালীন কাছের মিত্র পোল্যান্ড কর্তৃক প্রস্তাব, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং রণাঙ্গন থেকে সৈন্য প্রত্যাহারে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার আলোচনা এবং ভুট্টো নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে হাজির হয়ে তার জীবনের স্মরণীয় ও আবেগময় ভাষণ দেন। তিনি বলেছিলেন, “আমি চরম অপমানজনক আত্মসমর্পণে রাজি হতে আসিনি।”
“নিরাপত্তা পরিষদ যদি আমাকে অপমানজনক আত্মসমর্পণকে বৈধতা দিতে চায়, তাই আমি নিরাপত্তা পরিষদ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি কিন্তু অধিবেশন বয়কট করছি না। আপনারা যে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারেন…… আমি চললাম” বলে সোভিয়েত সমর্থনপুষ্ট পোলিশ প্রস্তাবের কপিটিকে ছিঁড়ে ফেলে নিরাপত্তা অধিবেশন থেকে বের হয়ে আসে। সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি স্বীকৃতি দেয়।
ইন্দো-সোভিয়েত বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য অনস্বীকার্য অবদান রাখেন এবং স্নায়ুযুদ্ধের বিজয়ের স্বাদ অবলম্বন করে সার্বভৌম বাংলাদেশকে দিয়ে। ইতিহাস সোভিয়েতকে বরণ করেছে, অত্যাচার নিপীড়নকে বিলুপ্তকরণ করেছে, সত্যকে আলিঙ্গন দিয়েছে, মিথ্যাকে হরণ করেছে, আর ইতিহাসকে মুদ্রণ করেছে, আর সেই ইতিহাসও তাদেরকে ধারণ করেছে।
লেখা; মো. মঞ্জুরুল হক ফাহিম, ভাইস-চেয়ারম্যান, মাষ্টারমাইন্ড কনসালটেন্সী লিমিটেড
সূত্র – ঢাকাট্রিবন
এ এস/
Discussion about this post