জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত ছাত্র-জনতাকে চিকিৎসা দিতে অস্বীকার করা ও বাধা দেওয়া চিকিৎসকদের বিএমডিসির নিবন্ধন বাতিলসহ ১০ দফা দাবি জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী শিক্ষক-চিকিৎসক, কর্মকর্তা-নার্স ও কর্মচারী ঐক্য পরিষদের নেতারা। বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ডা. মিলন হলে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষক-চিকিৎসক, কর্মকর্তা-নার্স ও কর্মচারী ঐক্য পরিষদ আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১৬ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে যে অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজন প্রীতি হয়েছে এবং শিক্ষক, কর্মকর্তা, নার্স ও কর্মচারীদের সঙ্গে যে ধরনের অন্যায়, অবিচার ও বৈষম্য করা হয়েছে, তা নজিরবিহীন। তবে জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর আমরা নতুন এক স্বাধীনতা অর্জন করেছি।
তারা বলেন, বিগত ১৬ বছর ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার এ দেশে একটি মাফিয়া শাসন কায়েম করেছিল। তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা, নার্স ও কর্মচারীরা।
এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ডা. শেখ ফরহাদ বলেন, ‘জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলনের সময় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থানরত প্রশাসনের আওয়ামী দোসররা আহত ছাত্র-জনতার চিকিৎসা দিতে বাধা দেওয়াসহ পুলিশি হয়রানি করেছে। গত ৩ আগস্ট এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সি-ব্লকের সামনে চিকিৎসকের অবস্থান কর্মসূচিতে হামলা চালিয়ে দুই জনকে রক্তাক্ত করা হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ আগস্টে জ্বালাও পোড়াও এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে কোটি কোটি টাকার সরকারি সম্পদ নষ্ট করা হয়। এসব ঘটনায় বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। শিগগিরই সেই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আমরা প্রকাশ করবো এবং দোষীদের বিরুদ্ধে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নেবো।’
বৈষম্যবিরোধী শিক্ষক-চিকিৎসক, কর্মকর্তা-নার্স ও কর্মচারী ঐক্য পরিষদের ১০ দফা দাবি হলো–
১. আহত ছাত্র-জনতাকে যারা চিকিৎসা দিতে অস্বীকার ও বাধা দিয়েছে, তাদের তালিকা তৈরি করে বিএমডিসির রেজিস্ট্রেশন বাতিল করতে হবে। শান্তি সমাবেশে যোগদানকারী ও ফ্যাসিবাদের দোসর সব শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা, নার্স ও কর্মচারীকে তার পদ থেকে অব্যাহতি দিতে হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া গ্রহণ করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
২. গত ১৬ বছরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত সব দুর্নীতি ও অনিয়মের শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে এবং সব কেনাকাটা, টেন্ডার ও নির্মাণে অনিয়মের তদন্ত করে বিচার করতে হবে।
৩. বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের কারণে বিএসএমএমইউতে যেসব শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা, নার্স ও কর্মচারী চাকরিচ্যুত, পদাবনতি ও বরখাস্ত হয়েছেন, তাদের স্ব-স্বপদে বহাল এবং উচ্চ শিক্ষা অর্জনে যে বৈষম্যমূলক বাধা দেওয়া হয়েছে, তা দূর করতে হবে।
৪. বৈষম্যের শিকার সব শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা, নার্স ও কর্মচারীদের অতি দ্রুত ভূতাপেক্ষভাবে পদোন্নতি দিয়ে বৈষম্য দূর করতে হবে।
৫. গত ৪ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদতে সাবেক উপাচার্যের একান্ত সচিব এবং সাবেক প্রক্টরের নেতৃত্বে একদল আওয়ামী সন্ত্রাসী শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা, নার্স ও কর্মচারী পরিকল্পিতভাবে শাহবাগের আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকে আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্রসহ আক্রমণ করে। এতে বহু ছাত্র-জনতা হতাহত হয়। এছাড়া আগুন সন্ত্রাসের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার সরকারি সম্পদ ধ্বংসের ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা ও মামলা দায়ের করে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।
৬. সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত থেকে শুরু করে স্বৈরাচারের নিয়োগ করা সব ভিসি, প্রো-ভিসি, ট্রেজারার, রেজিস্ট্রার ও প্রক্টরদের এবং অন্যদের দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদের হিসাব দুদকের মাধ্যমে তদন্তের ব্যবস্থা করতে হবে।
৭. সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল ও বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা কনভেনশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, সে বিষয়ে শিগগিরই মন্ত্রণালয় ও বিচার বিভাগের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে।
৮. বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের আতুর ঘর হিসাবে বিবেচিত মুজিববাদ প্রেরণার উৎস হিসেবে পরিচিত হওয়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শিগগিরই পরিবর্তন এবং ৫ আগস্টের বিপ্লবের চেতনাবিরোধী সব ম্যুরাল ও মূর্তি সরিয়ে ফেলতে হবে।
৯. এই বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ ১৬ বছরে সংঘটিত সব অনিয়ম, দুর্নীতির ও বৈষম্য তদন্তে একটি শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে।
১০. ২০০৩ সাল থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের পদোন্নতি সংক্রান্ত ২০০৮ সালের প্রজ্ঞাপন ২০০৯ সালের ৩৩তম সিন্ডিকেট সভায় বাতিল করার আদেশটি শিগগিরই বাতিল করে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী চিকিৎসকদের ভূতাপেক্ষভাবে পদোন্নতি দিতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন বৈষম্যবিরোধী শিক্ষক-চিকিৎসক, কর্মকর্তা-নার্স ও কর্মচারী ঐক্য পরিষদ বিএসএমএমইউর সভাপতি ডা. মো. দেলোয়ার হোসেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক ডা. মো. রুহুল কুদ্দুস (বিপ্লব)। এ সময় অন্যান্যেরে মধ্যে বক্তব্য রাখেন বিএসএমএমইউর প্রক্টর ডা. শেখ ফরহাদ, ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরামের (এনডিএফ) বিএসএমএমইউ শাখা সভাপতি ডা. আতিয়ার রহমানসহ আরও অনেকে।
এ ইউ/
Discussion about this post