গাজা যুদ্ধ সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের জন্য সমস্যা তৈরি করেছে। কারণ ইসলামী সংগঠন হামাস গাজা শাসন করছে। এ সংগঠনটি ইরান এবং তার সমর্থক গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ। তারা সৌদি রাজপরিবারকে পছন্দ করে না। কিন্তু সৌদি আরবের নাগরিকদের জন্য ফিলিস্তিন বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তারা ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতিশীল বলেই মোহাম্মদ বিন সালমানকে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। আরব ও মুসলিম বিশ্ব মনে করে, ইসরায়েলি দখল ও আগ্রাসনের শিকার ফিলিস্তিন।
অন্যদিকে সৌদি সরকার তার নিরাপত্তা জোরদার করতে চায় এবং দেশটি আশা করে, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের মাধ্যমে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সঙ্গে নিরাপত্তা জোটে থাকবে। কিন্তু রিয়াদ এখন সেটি করতে পারছে না। কারণ ইসরায়েল গাজার বেসামরিক নাগরিকদের ওপর বোমা ফেলছে এবং ফিলিস্তিনিদের নিজেদের রাষ্ট্রের অধিকার অগ্রাহ্য করছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ সৌদি রাজপরিবারের হাত শক্তিশালী করার জন্য যথেষ্ট নয়। শক্তিশালী অর্থনীতি গড়া এবং দেশটির অভ্যন্তরীণ মতাদর্শে পরিবর্তন আনার মাধ্যমে তারা তাদের শাসন ও স্বার্থ সুরক্ষিত করতে পারে। সে জন্য সৌদি আরব জ্বালানি খাতের বাইরে অন্যান্য ক্ষেত্রেও সক্রিয়ভাবে নজর দিচ্ছে। যেমন পর্যটন, খনিজ, লজিস্টিকস বা সরঞ্জাম উৎপাদন, প্রযুক্তি, অর্থনীতি এবং পরিবহন খাত। সৌদি রাজপরিবার এমনকি ইসলামের দিক থেকে তার যে অবস্থান তথা ওয়াহাবিজম, সেখানেও পরিবর্তন আনতে চায়। রাজকীয় পরিবার ইসলামের সবচেয়ে পবিত্র স্থান দুটির দায়িত্বশীল। তারা রাজতন্ত্রের পরিবর্তে নিজেদের সৌদি জনগণের রক্ষক হিসেবে উপস্থাপন করে এবং সৌদি স্বার্থ সুরক্ষার ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদের প্রচার করে। যার ফলে দেশটির সর্বক্ষেত্রে পরিবর্তন আসছে। শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুরু করে ধর্মীয় অধিকার, নারীর ভূমিকায় পরিবর্তনসহ তারা সমাজের প্রতিটি দিককে অন্তর্ভুক্ত করছে। ‘সঠিক ইসলাম’ প্রচারে নিজেদের অঙ্গীকারবদ্ধ করতে অঞ্চলে ঐক্য, শান্তি এবং সমৃদ্ধি আনার ক্ষমতার ওপর জোর দিচ্ছে।
সৌদি আরবের এই পরিবর্তনের পথে গাজা যুদ্ধ সংকট তৈরি করেছে। এমনকি এখনও সৌদি আরব ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে প্রত্যাশী। কিন্তু এই কূটনৈতিক সম্পর্কের জন্য সৌদি আরব ইসরায়েলের কাছে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের গ্যারান্টি চাইছে। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিতে তারা যুক্তরাষ্ট্রকে ‘ম্যানেজ’ করার চেষ্টা করছে। এ ক্ষেত্রে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝানোর ক্ষেত্রে সৌদি আরবের লক্ষ্য শুধু ফিলিস্তিনিদের সংকট দূর করাই নয়; বরং তারা এর মাধ্যমে ইরান ও তার সমর্থক গোষ্ঠীকেও দুর্বল করতে চায়। রিয়াদ বিশ্বাস করে, ইসরায়েলি-ফিলিস্তিন সংঘাত শেষ হয়ে গেলে তেহরান দুর্বল হবে এবং মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা আসবে। এর পর সৌদি আরব যেমন তার জাতীয় রূপান্তর সম্পন্ন করতে পারবে, তেমনি সমৃদ্ধ অঞ্চল গড়ার লক্ষও পূরণ হবে, যেখানে অঞ্চলের মুরব্বি হবে সৌদি আরব।
মোহাম্মদ বিন সালমান যেমন তাঁর শত্রুদের ব্যাপারে সজাগ, তেমনি তাঁর সক্ষমতাও তিনি জানেন। সে জন্যই মনে করছেন, ইরান ও তার মিত্ররা কখনোই সৌদি আরবের বন্ধু হবে না এবং ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক দিক থেকে এতটাই শক্তিশালী যে, তাদের পুরোপুরি পরাস্ত করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া অভিজ্ঞতা থেকেও তারা শিক্ষা নিচ্ছে। মিসরের জামাল আবদেল নাসের আরব জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী মতাদর্শ ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। বাথ পার্টি এবং সামরিক আগ্রাসনের মাধ্যমে একই চেষ্টা করেছিলেন ইরাকের সাদ্দাম হোসেন। কিন্তু তাতে বিপর্যয় হয়। এটা স্পষ্ট– ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গড়তে সামরিক সমাধান কাজে আসবে না এবং যুক্তরাষ্ট্রকেও মধ্যপ্রাচ্য থেকে জোরপূর্বক বের করে দেওয়া সম্ভব নয়।
সৌদি আরব চায় এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব থাকুক। মোহাম্মদ বিন সালমানের ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বৃহত্তর নিরাপত্তা চুক্তির অংশবিশেষ। ইসরায়েলে সৌদি আরবের দূতাবাস স্থাপনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌদি আরব এমন প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে চেয়েছিল, যা সৌদিকে বাইরের আক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে পারমাণবিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারবে। ১৯৪৫ সালে ইবনে সৌদ এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্টের মধ্যে সম্পর্ক দুই দেশের মধ্যে যে সহযোগিতা ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচনা করেছিল; মোহাম্মদ বিন সালমান ঘনিষ্ঠতার মাধ্যমে তার চেয়ে বেশি ফল পেতে চাইছেন।
যদিও এখন ইসরায়েল গাজায় যে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে, তাতে সৌদি আরবের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা দীর্ঘ মেয়াদে নেই বললেই চলে। ২০১১ সালের আরব বসন্তের মাধ্যমে ফিলিস্তিন বিষয়টি গুরুত্ব হারিয়েছিল। কিন্তু ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর তা আবার মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে। ফিলিস্তিনে হামলার জন্য সৌদিরা বাকি আরব বিশ্বের সঙ্গে ইসরায়েলের নিন্দা করতে বাধ্য। ফলে সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং যুবরাজরা ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে যুদ্ধাপরাধ বলে নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। তারা অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। জানুয়ারির শেষ দিকে সৌদি সরকার আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে দক্ষিণ আফ্রিকার অভিযোগকে সমর্থন করে বলেছে, ইসরায়েল গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে।
যদিও এসব বিবৃতি অঞ্চলের অন্যান্য দেশের কঠোর সমালোচনার চেয়ে কমই গুরুতর। বলা যায়, সৌদি আরব শিগগিরই তাদের স্বাভাবিকীকরণের চেষ্টা শুরু করবে। এখনই কার্যকর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র তৈরি হবে– এমন ছাড় যে ইসরায়েল দেবে, এমনটা নয়। মোহাম্মদ বিন সালমান স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের চেয়ে কম কিছুতে রাজি হলে তাঁকে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’র দায়ে দায়ী করা হবে। কারণ তিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আরব নেতা এবং ইসলামের পবিত্রতম দুটি স্থানের অভিভাবক।
তবে ইসরায়েলের পোড়ামাটি নীতি এবং দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ব্যক্তিগত রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে সৌদি-ইসরায়েল সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, বলা মুশকিল। তবে হামাসের আক্রমণ ফিলিস্তিনকে এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে সামনে নিয়ে এসেছে, রিয়াদও নিজের জাতীয় স্বার্থের চিন্তায় নড়েচড়ে বসেছে। এটি সৌদি আরবকে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের কট্টর সমর্থক হিসেবে ফের সামনে নিয়ে এসেছে। সে জন্য বলা যায়, হামাস ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি বিজয় নিশ্চিত করেছে– তবে সেটা সম্ভবত নিজের জন্য নয়।
লেখক বার্নার্ড হাইকেল: যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক; ফরেন অ্যাফেয়ার্স থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক
সূত্র -সমকাল
এ এস/
Discussion about this post