গাজায় গণহত্যা বন্ধ না করলে ইসরায়েলকে উল্লেখযোগ্য মাশুল গুনতে হবে। এমনকি বিরাট এক ভূমিকম্পের মতো ফলাফল ভোগ করতে হবে তাদেরকে। ২০২৩ সালের ১৪ অক্টোবর ইসরায়েলকে প্রকাশ্যেই এমন এক হুঁশিয়ারি দিয়েছিল ইরান। পরবর্তীতে জাতিসংঘে তেহরানের রাষ্ট্রদূত এ বিষয়ে আরও পরিষ্কার আলোচনা করেন। তিনি বলেন, ইসরায়েল যদি ইরানের স্বার্থে আঘাত করে অথবা ইরানি নাগরিকদের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, শুধু তখনই ইরান গাজা যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করবে, তার আগে নয়।
বিগত চার মাস ধরে চলা ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধে ইরানের ভূমিকা নিয়ে অনেকগুলো প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এর মাঝে একটি হলো- ঠিক কোন পরিস্থিতিতে সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে নামতে পারে তেহরান? ঠিক কতটা সীমা লঙ্ঘন করলে ইরান যুদ্ধে যোগ দিতে পারে, তার জন্য সহ্যের সীমা জেনে রাখা প্রয়োজন। ইরান সবচাইতে বেশি গুরুত্ব দেয় রাষ্ট্রটির সার্বভৌমত্বকে। ইরানের সামুদ্রিক সীমানা, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর ওপর হামলা দেশটির নেতারা বরদাশত করবে না, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত এলে নিঃসন্দেহে তারা প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেবে।
অতীতে ইরানের সরকার হামাসের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ অস্বীকার করেছে। ফিলিস্তিনের বিদ্রোহীদের সঙ্গে মূল্যবোধের মিল থাকলেও তেহরান নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে আসছে খুব সাবধানে। কারণ, হামাসের সঙ্গে সরাসরি যোগসাজশে দেশটির ভেতরে দেখা দিতে পারে অস্থিরতা। এদিকে, হামাসের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখলেও লেবাননের ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হিজবুল্লাহের প্রতি ইরানের সমর্থন বরাবরই রয়েছে শক্তপোক্ত।
এখন পর্যন্ত গাজা যুদ্ধে ইরানের হস্তক্ষেপ কূটনৈতিক পর্যায়েই সীমাবদ্ধ। গাজায় নির্বিচারে হত্যা বন্ধ, মানবিক সহায়তা সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং গাজা থেকে ইসরায়েলি বাহিনী সরিয়ে নেওয়ার জন্য দেশটি তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে। তাদের একটি লক্ষ্য হলো ফিলিস্তিনের বিদ্রোহীদের বড় কোনো ক্ষতি এড়ানো। বড় সংখ্যায় ফিলিস্তিনিরা যেন নিজেদের ভূমি ছেড়ে উদবাস্তু না হয়, সেটাও ইরানের আরেকটি লক্ষ্য।
ইসরায়েল এবং মার্কিন শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা ইরানের দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিম এশিয়ায় পাশ্চাত্যবিরোধী বড় ধরনের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চায় ইরান। এর পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্য থেকে মার্কিন শক্তি হঠাতেও চায় দেশটি। ইসরায়েলের পক্ষ নিয়ে যেভাবে সর্বত্র ওকালতি করে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র, এ থেকে তেহরানের অনেকেই বিশ্বাস করেন; গাজা যুদ্ধের কলকাঠি নাড়া হচ্ছে ওয়াশিংটন থেকে। তাই যুক্তরাষ্ট্র আর ইসরায়েলের মাঝে বিভেদ বাড়ানোর ক্ষেত্রেও ইরান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
গাজায় জাতিগত নির্মূল প্রক্রিয়া চালানোর পথে অটল রয়েছে ইসরায়েল। তা বন্ধ করতে ইরান বেছে নিয়েছে কূটনৈতিক পন্থা। সরাসরি নয়, বরং মার্কিন নীতিকে সূক্ষ্মভাবে প্রভাবিত করতে চাইছে তারা। এভাবে সরাসরি যুদ্ধে না গিয়েও ইরান যুদ্ধের ময়দানে নিজেদের ছাপ রাখতে চেষ্টা করছে।
ইসরায়েলের চোরা হামলা
গত সপ্তাহেই ইরানের গ্যাস সরবরাহ পাইপলাইনের ওপর বড় ধরনের একটি হামলা হয়। এ হামলাকে নাশকতা এবং সন্ত্রাসী হামলা বলে অভিহিত করেন ইরানের জ্বালানি মন্ত্রী জাভাদ ওজি। বেশকিছু শহরে শীতকালে জ্বালানি সরবরাহে বিপর্যয় তৈরি করে দেশটিতে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা উসকে দেওয়া ছিল শত্রুদের লক্ষ্য, তিনি বলেন।
এখন পর্যন্ত কোনো দেশ বা সংগঠন এই হামলায় দায় নেয়নি। নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বেশকিছু সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়, এই হামলার নেপথ্যে ছিলো ইসরায়েল।
এই হামলায় ইরানের প্রায় ৪০ শতাংশ জ্বালানি সরবরাহ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারত। কিন্তু এত বড় ধরনের হামলা হওয়ার পরেও একে ইসরায়েলের ‘সীমালঙ্ঘন’ হিসেবে ধরেনি ইরান। তার মূল কারণ হলো, হামলার পরে দ্রুত ক্ষয়ক্ষতি সামলে নিতে সক্ষম হয় ইরান।
ইরান আর ইসরায়েলের মাঝে এসব চোরাগোপ্তা হামলা বিভিন্ন ধাপে ধাপে অগ্রসর হচ্ছে। আকাশপথ, স্থলপথ, সমুদ্রপথ ছাড়াও ইন্টারনেটের মাধ্যমেও হামলা-পাল্টা হামলা চলছে অনেকদিন ধরেই। তবে ইদানিং হামলার মাত্রা বাড়তে দেখা যাচ্ছে এবং শীঘ্রই হয়তো ইসরায়েল এমন কোনো সীমা অতিক্রম করবে যার ফলে সম্মুখ সমরে যেতে বাধ্য হবে ইরান।
ইরানের প্রত্যুত্তর
মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য অঞ্চলেও গাজা যুদ্ধের প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে পড়তে পারে, ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি বলেন। এ ব্যাপারটা মার্কিনিদের জন্য বড় ধরনের মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ, তারা বারবারই নিজেদের মিত্র দেশগুলোকে বলে আসছে যুদ্ধ যেন অন্যত্র না ছড়ায়। মার্কিন এই হুঁশিয়ারিকে অন্য দেশগুলো তেমন আমলে নেয়নি। গাজায় ইসরায়েলের হামলা শুরুর চার মাস পর স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে- লেবানন, সিরিয়া, ইরান, এমনকি ইয়েমেন থেকেও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েছে।
শুধু তাই নয়, ফিলিস্তিনের এসব মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে বেশি বাড়াবাড়ি করলে তেহরান কিছু না কিছু ব্যবস্থা নেবে বলে ধরে নেওয়া যায়।
তেমন কিছু হওয়ার আগ পর্যন্ত ইরানের মিত্রবাহিনীগুলো- যেমন লেবাননের হিজবুল্লা, ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ, ইরাক ও সিরিয়ার বিদ্রোহী দলগুলো, এবং ইয়েমেনের আনসারাল্লাহ। এরা ইরানের সরাসরি হস্তক্ষেপ ছাড়াও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বজায় রাখবে; এটাও অনেকটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল মুখে দাবি করছে তারা চায় না যুদ্ধ ছড়িয়ে যাক। কিন্তু তাদের সেনাবাহিনী ইতোমধ্যেই বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। এর উত্তরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো চুপ করে নেই। তারা সবদিক থেকেই ইসরায়েলকে প্রতিহত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মূলত, যুক্তরাষ্ট্র যেন গাজা থেকে ইসরায়েলকে পিছু হটতে চাপ দেয়, এই উদ্দেশ্যে তারা প্রতিরোধ বজায় রেখেছে।
ইউরোপ এবং পশ্চিমা দেশগুলোর কেউই চায় না গাজায় যুদ্ধ প্রলম্বিত হোক। জ্বালানি সুরক্ষা, আঞ্চলিক অর্থনীতি, অস্থিরতা ও কূটনৈতিক দিক দিয়ে এই যুদ্ধ তাদের জন্য ক্ষতিকর। এদিক দিয়েই ইরান সূক্ষ্মভাবে অগ্রসর হচ্ছ- যাতে আমেরিকা ও ইউরোপের মাঝে বিভেদ দেখা যায়। আর ফলাফল হিসেবে তারা দাঁড়িয়ে যায় ইসরায়েলের বিপক্ষে।
সার্বিক পরিস্থিতি
ইরানের অবস্থান দেখে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, তারা যতটা না ইসরায়েল বিরোধী, তার চেয়ে বেশি মার্কিন বিরোধী। মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক বিভিন্ন মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি সমঝোতায় আসার চেষ্টা করছে। এই সমঝোতার লক্ষ্য হলো গাজার ওপর থেকে ইসরায়েলের চাপ সরিয়ে নেওয়া এবং একটি যুদ্ধবিরতির ব্যবস্থা করা।
অতীতে এই এলাকায় ইসরায়েলের সঙ্গে অন্যান্য দেশের সংঘর্ষ হয়েছে, যেমন লেবাননের হিজবুল্লাহের সঙ্গে। ফলে ইরান জানে, ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ শক্তি কমিয়ে আনা এবং বৈদেশিক সমর্থন কমিয়ে আনা- দুটোরই প্রয়োজন আছে। এই দুই দিক দিয়ে ইসরায়েলকে আঘাত করা গেলে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের আধিপত্যে অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব।
শুধু তাই নয়, গাজা যুদ্ধকে গুটি হিসেবে ব্যবহার করে মধ্যপ্রাচ্যে নিজের প্রভাব বাড়াতে চায় ইরান। এই এলাকায়র বিভিন্ন চুক্তি (যেমন ক্যাম্প ডেভিড অ্যাকর্ডস) দমিয়ে আনতে চায় দেশটি। এছাড়া ২০০০ সালের দিকে ইসরায়েল আর আরব দেশগুলোর মাঝে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে আনার প্রক্রিয়াটিও তারা বন্ধ করে দিতে চায়। এর পাশাপাশি অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন (ওআইসি), দি আরব লিগ, ব্রিকস এবং শাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) মাধ্যমে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক সমর্থন গড়ে তুলতে চায় ইরান। তবে মস্কো এবং বেইজিং তেহরানের দুই বড় মিত্র- এখনো সম্মুখ যুদ্ধে সায় দেয়নি। তাই ইরান রাশিয়া এবং চীনের সঙ্গে সরাসরি বিরোধে গিয়ে কোনো যুদ্ধে অংশ নেবে না, এটা ধরে নেওয়া যায়।
গাজায় ভরসা রেখে বাজি ধরবে ইরান?
গাজা যুদ্ধে সরাসরি মাঠে নামাতে গেলে বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে ইরান। এর মাঝে রয়েছে প্রচুর হতাহতের শঙ্কা, অর্থনৈতিক ক্ষতি এবং তেল রপ্তানিতে ভাটা।
তেহরানের সঙ্গে সীমালঙ্ঘন করলেই শুধুমাত্র যুদ্ধে যাওয়ার চিন্তা করবে ইরান। ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডের নেতা জানুয়ারি মাসে বলেছিলেন, ইরান যুদ্ধ চায় না, তারমানে এই না যে, ঝুঁকি এলে ইরান চুপ করে থাকবে।
এখানে জেনে রাখা প্রয়োজন- ইরান গাজা যুদ্ধকে শুধুমাত্র আদর্শগত দিক দিয়ে বিবেচনা করছে না। বরং তা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী, বাস্তববাদী চিন্তা করছে। বর্তমানে যুদ্ধে না গিয়েও তারা প্রতিরোধ গড়ে তুলছে বটে। কিন্তু ভবিষ্যতে তারা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে। হিসাব-নিকাশ করে ইরান বুঝতে পেরেছে, তাদের ওপর সরাসরি হামলা করার দায় যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েল কেউই নেবে না। তবে দুই পক্ষের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি এবং হিসাবে গরমিল থেকে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে যুদ্ধের দিকে মোড় নিতে পারে।
লেখক; ফারজাম রামেজানি বনেশ: বৈশ্বিক বিষয়ের গবেষক; দ্যা ক্রেডল থেকে ভাষান্তর খায়রুন নাহার
সূত্র – সমকাল
এ এস/
Discussion about this post