সংসারে সচ্ছলতা আনতে আট বছর আগে ঋণ করে বিদেশে যান মুন্সিগঞ্জের সালমা বেগমের স্বামী। কিন্তু সে ঋণ আর শোধ হয়নি। বরং সুদ-আসল মিলে দিনে দিনে বেড়েছে ঋণের বোঝা। একপর্যায়ে এনজিও আর সুদের কারবারিদের চাপ সইতে না পেরে দুই ছেলেমেয়েকে বিষপান করিয়ে গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেন সালমা। শুধু তিনিই নন, এমন ক্ষুদ্রঋণের ঘেরাটোপে বন্দী অসংখ্য নারীর জীবন। ঋণের কিস্তি শোধ করতে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেন তাঁরা। কেউ আবার কুলিয়ে উঠতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
নারী অধিকারকর্মীরা বলছেন, দরিদ্র নারীদের স্বাবলম্বী করতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ আসছে না। যে বিনিয়োগগুলো আসছে সেগুলোও সঠিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না। ফলে দরিদ্র নারীরা উপায়হীন হয়ে অনুমোদনহীন এমনকি দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছেন। এরপর অনেকেই ঋণ শোধ করতে নিজের শেষ সম্বলটুকুও হারাচ্ছেন।
এমন প্রেক্ষাপটে আজ ৮ মার্চ সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে নারী দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘নারীর সমঅধিকার, সমসুযোগ, এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ’।
বিভিন্ন গবেষণা বলছে, নারীরা ক্ষুদ্রঋণ পেলেও সেই টাকা খরচ করেন পুরুষেরাই। অনুমোদন পেয়ে বা না পেয়ে গজিয়ে ওঠা অসংখ্য ক্ষুদ্রঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের ঋণের বলি হচ্ছেন দরিদ্র নারীরা।
সালমার মৃত্যুর রেশ না কাটতেই গত সোমবার গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন মেহেরপুরের মুজিবনগরের নুরজাহান খাতুন। স্বজনেরা বলেছেন, সালমার মতো নুরজাহানও ঋণের চাপে আত্মহত্যা করেছেন।
একাধিক এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছেন রাজধানীর আফতাবনগরের বাসিন্দা গৃহকর্মী পারুল আক্তারও। বেশ কিছুদিন ধরে জন্ডিসসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন তিনি। চিকিৎসক চার সপ্তাহ বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু কিস্তির চাপে বিশ্রাম করার সুযোগ নেই। পারুল বলেন, ‘বিশ্রাম নিলে ঋণের কিস্তি দেওনের টেকা আইবো কোত্থেইকা? মরি আর বাঁচি কাজ তো করনই লাগব।’
২০২২ সালের জুনে প্রকাশিত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) সমাজবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের সহযোগী অধ্যাপক ড. তানভীর আহমেদ সোহেল এবং অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই গবেষক ড. সারা নাইনার ও ড. সামান্থি জে গুনাওয়ার্দানার গবেষণাপত্রে বলা হয়, নারীরা ঋণ পেলেও মূলত তা খরচ করেন পুরুষেরা। অনেক ক্ষেত্রে ঋণের টাকা কোথায় ব্যবহৃত হবে, তা নির্ধারণ করে দেন বাড়ির পুরুষেরা।
মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, দেশে ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতার সংখ্যা ৪ কোটি ৪৬ লাখ। এই ঋণগ্রহীতার ৯০ শতাংশই নারী। এমআরএর ২০২২ সালের প্রতিবেদন বলছে, ওই বছরের জুন পর্যন্ত এমআরএর সনদপ্রাপ্ত ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক, সরকারের বিভিন্ন দপ্তর ও বিশেষ কর্মসূচির বিতরণ করা ক্ষুদ্রঋণের পরিমাণ ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। ঋণের স্থিতি প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। আর চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে সনদপ্রাপ্ত ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৭৩৭টি। আর সাময়িক অনুমোদনপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান আছে ৩৮৪টি। অন্যদিকে ১৫৫টি প্রতিষ্ঠানের সনদ বাতিল হয়েছে। বিভিন্ন ক্ষুদ্রঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের শর্তে থাকে, এক এনজিওর (ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান) সদস্য অন্য এনজিওর সদস্য হতে পারবেন না। কিন্তু এনজিওকর্মীরা নিজেদের চাকরি বাঁচাতে সেই নীতিমালা অগ্রাহ্য করেন।
মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির এক্সিকিউটিভ ভাইস চেয়ারম্যান মো. ফসিউল্লাহ বলেন, ‘আমাদের আওতাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মের কোনো ব্যত্যয় করে থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিই। মামলা করি, পুলিশকে জানাই। কোনো ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে কেউ যদি অভিযোগ জানায়, আমরা সেটাও খতিয়ে দেখি। সাম্প্রতিক যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেখানে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের দায় কতটুকু, তা আমরা দেখব।’
এফএস/
Discussion about this post