বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) গভীর রাতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী প্রবেশের প্রতিবাদ ও ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবিতে কয়েক দিন ধরে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে মতামত দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক দুই ছাত্রনেতা।
আমি বুয়েটের একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী। ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। আমরা দেখেছি, দেশের ক্যাম্পাস-রাজনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে চমৎকার রাজনীতির চর্চা হয়েছে। আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন সেখানে শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ ছিল। কিন্তু বর্তমানে ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’র ব্যানারে মৌলবাদীরা নেপথ্যে থেকে ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল করার চক্রান্তে তৎপর। গত কয়েক দিন তারা ছাত্র রাজনীতি বন্ধ অব্যাহত রাখার দাবি জানিয়ে আন্দোলন করেছে, যদিও সর্বোচ্চ আদালত ইতোমধ্যে ছাত্র রাজনীতি অব্যাহত রাখার পক্ষে রায় দিয়েছেন।
ইতোমধ্যে উপাচার্য আলোচনায় বসার জন্য তথাকথিত সাধারণ শিক্ষার্থীদের আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা এতে সাড়া দেয়নি। তাদের কার্যকলাপে বোঝা যাচ্ছে, এখানে সংঘবদ্ধ কোনো নেতৃত্ব রয়েছে, যারা নিজেদের রাজনীতির স্বার্থে আন্দোলনে জড়িত। আমাদের মনে হয়েছে, তারা মূলত ছাত্রলীগমুক্ত ছাত্র রাজনীতি চায়।
এ ক্ষেত্রে তারা আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তুলে ধরছে এবং এ পরিপ্রেক্ষিতে ক্যাম্পাসে রাজনীতি বন্ধ অব্যাহত রাখার দাবি জানিয়ে যাচ্ছে। এ হত্যাকাণ্ডে দোষীদের আদালত এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এ শাস্তির ব্যাপারে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের সাবেক কিংবা প্রাক্তন কোনো নেতাকর্মী কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি। এ ধরনের আরও দুটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এই ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী সাবিকুন্নাহার সনি ও দ্বীপের মৃত্যু হয়েছে। ছাত্রদলের দু’গ্রুপের গোলাগুলিতে সনি এবং মৌলবাদীরা দ্বীপকে কুপিয়ে হত্যা করেছিল। এসব ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা আমরা সবসময় জানিয়েছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব একটা স্ট্যাটিউট আছে। এই আইনবলে ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার এখতিয়ার প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের রয়েছে। তবে আমাদের একমাত্র লক্ষ্য এই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি উন্মুক্ত করে দিতেই হবে, বরং যে মৌলবাদীরা সেখানে রাজনৈতিকভাবে তৎপর হয়ে উঠছে সেটাকে প্রতিরোধ করা। মূলত ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ রাখার যে প্রক্রিয়া চলছে, সেই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে এখানে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনগুলো সক্রিয় হয়ে উঠছে। এটা ঠেকানো জরুরি। সেই প্রেক্ষিতে আমরা মনে করি, ক্যাম্পাসে সব ধরনের ছাত্র সংগঠন ক্রিয়াশীল থাকলে নিষিদ্ধ সংগঠনগুলো জায়গা নিতে পারবে না।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, ক্যাম্পাস ভালো চলছে, অস্থিতিশীলতা নেই। আদতে এটা ঠিক নয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নীরবতার কারণেও মৌলবাদী সংগঠনগুলো সুযোগ নিচ্ছে। পুরো প্রতিষ্ঠানকে ভিন্ন দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে। প্রশাসন এখানে জিম্মি হয়ে পড়েছে। তারা আপসের ভাষায় কথা বলে। এখানে তদন্ত ছাড়াই সিট বাতিলের ঘটনা ঘটেছে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এমন ভাষা আগে কখনও দেখা যায়নি। আমরা দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ঘটনা ঘটলে কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি করে এবং নিরপেক্ষভাবে ঘটনার তদন্ত হয়। এই শিক্ষাঙ্গনে কখনও সংঘবদ্ধভাবে পরীক্ষা বন্ধ রাখা হলো, কিন্তু তদন্ত কমিটি করে কাউকে শোকজ করা হলো না– এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। এ ধরনের কর্মকাণ্ড মেনে নেওয়া যায় না।
একজন ছাত্রনেতা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করায় শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে। এটা কোনো যুক্তি হতে পারে না। একজন ছাত্রনেতা শিক্ষাঙ্গনে প্রবেশ করাতে কী ক্ষতি হয়েছে? বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটা আদেশবলে ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করেছে। এই এখতিয়ার তাদের আছে। তাই বলে কি কোনো ছাত্রনেতা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলেই ছাত্র রাজনীতির দরজা খুলে গেল!
মূলত ছাত্রলীগের রাজনীতি বন্ধ রাখার মধ্য দিয়ে তারা এ ক্যাম্পাসকে মৌলবাদী রাজনীতিচর্চার ক্ষেত্র করতে চায়। এখানেই আমাদের ভয়। এ কারণে আমরা চাই, বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ধরনের ছাত্র সংগঠন সক্রিয় হয়ে উঠুক। ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন সবাই সক্রিয় থাকুক। যারা অপরাধ করবে, তাদের বিরুদ্ধে আমরা সবাই সোচ্চার হবো।
বাংলাদেশের সুশীল সমাজের কিছু অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থিতিশীলতা আনতে গিয়ে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের পক্ষে কথা বলে। তারা মনে করে, ছাত্র রাজনীতির কারণে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আসলে বাস্তবতা সে রকম নয়। মূলত জাতীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তির কারণেই ক্যাম্পাস রাজনীতি এ অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি বন্ধ হলেই ক্যাম্পাসে সুষ্ঠু রাজনীতি ফিরিয়ে আনা সম্ভব। কেন্দ্রীয় রাজনীতি থেকে লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি আলাদা করতে পারলে এসব প্রশ্ন আর উঠত না। প্রতিটি রাজনৈতিক দল স্বাধীনভাবে রাজনীতি করবে। আওয়ামী লীগের যেমন নিজস্ব রাজনীতি আছে, তেমনি ছাত্রলীগেরও নিজস্ব রাজনীতি থাকবে। একইভাবে ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট ছাত্রদের অধিকার নিয়ে রাজনীতি করবে।
আমরা ছাত্র রাজনীতির মধ্য দিয়ে নেতৃত্ব গঠনের প্রমাণ দেখেছি। সামরিক শাসন কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রসমাজের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সেটা ছাত্র রাজনীতির কারণেই সম্ভব হয়েছে। সুতরাং, রাজনীতির এই খোলা ময়দান বন্ধ রাখা সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। আদালত ছাত্র রাজনীতিকে সাধুবাদ জানিয়ে রায় দিয়েছেন। তবে লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি বন্ধ করতে দল-মত নির্বিশেষে সব ধরনের সংগঠনকে খোলামনে এগিয়ে আসা উচিত; সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে এগোতে হবে। ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হলে যে কোনো অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা কঠিন হয়ে পড়বে। ১৯৭০ ও ৮০-এর দশকে দেশের রাজনীতিতে আমরা তাই দেখেছি। বর্তমানে শিক্ষার্থীরা যেভাবে বিদেশমুখী হয়ে পড়েছে, সেটাও অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। ছাত্র রাজনীতি এই উৎকণ্ঠা নিরসনেও ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি। কেননা, রাজনীতি ব্যক্তিকে সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে।
লেখক; স্থপতি মোহাম্মদ মাসুম ইকবাল: অধ্যাপক, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ
সূত্র – সমকাল
এ এস/
Discussion about this post