ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু সম্ভবত ইউক্রেনের জেলেনস্কির চেয়ে বড় আহাম্মক। মানবজাতিকে তিনি ইতিহাসের বিপজ্জনক মোড়ের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। নেতানিয়াহুর কেন এখন আঞ্চলিক যুদ্ধ দরকার? কারণ, যতদিন যুদ্ধ চলবে ততদিন তিনি নেতা। তার পরে তিনি নেতা থেকে ইয়াহু হয়ে যাবেন।
ইংরেজ লেখক জোনাথন সুইফটের কল্পকাহিনি গালিভার্স ট্রাভেলস গল্পের এই ইয়াহু জাতির লোকেরা বর্বর, দাম্ভিক ও বেকুব। বাস্তবের নেতা-নি-ইয়াহু ভাবছেন তার ক্ষমতাসীন থাকা দেশ ও বিশ্বের জন্য জরুরি। সেজন্য ফিলিস্তিনে গণহত্যা চালানো এবং আমেরিকাকে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়ানোও জরুরি। কিন্তু দুর্নীতি, সংবিধান লঙ্ঘন এবং বন্দি মুক্তিতে ব্যর্থতার জন্য বহু ইসরায়েলি তাঁকে জেলে পাঠাতে চায়। আর মানবতাবাদী বিশ্ব চায় বর্বর গণহত্যাকারী হিসেবে তাঁকে কাঠগড়ায় তুলতে।
এদিকে ইরান-ইসরায়েলের সংঘাতের পারদ যত চড়ছে, তত ঘনিয়ে আসছে তৃতীয় আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা। নেতানিয়াহু প্রথমে ইসরায়েলকে হাইজ্যাক করেছেন, এখন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দুনিয়াকে হাইজ্যাক করতে সর্বনাশা জুয়ায় নেমেছেন। সিরিয়ায় ইরানি কনসুলেটে হামলা ছিল ইরানিদের জন্য দেওয়া তাঁর টোপ।
ইরান টোপ খেয়ে নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু বড়শি গেলেনি। দুই হাজার বছরের ইতিহাসে ইরান কোনো দেশে আগে হামলা চালায়নি। কিন্তু এবার চালাল। একের পর এক ইসরায়েলি নাশকতা ও হত্যাকাণ্ডের পর ইসরায়েলি মাটিতে মিসাইল ও ড্রোন হামলা চালাল ইরান। খুবই পরিকল্পিত ও পরিমিত হামলা। যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই, ইসরায়েলসহ আশপাশের দেশকে আগেভাগে জানিয়ে দিয়েছে, শিগগিরই হামলা শুরু হতে যাচ্ছে। এর অর্থ হলো, আমি শক্তির প্রকাশ দেখাব, কিন্তু যুদ্ধ বাধাব না।
ইরান যথেষ্ট স্মার্টলি খেলেছে। শত শত সস্তা ড্রোন আর পুরোনো মিসাইলের উড়ন্ত মিছিলের মধ্যে লক্ষ্যভেদী অব্যর্থ মিসাইলগুলোকে ঢেকে রাখতে পেরেছে। যেখানে ইরানের খরচ মাত্র কয়েক মিলিয়ন ডলার, সেখানে হামলা মোকাবিলায় ইসরায়েলের এক রাতের খরচ ১.৩ বিলিয়ন ডলার। তারপরও ইসরায়েলে শত শত ড্রোনের ভিড়ে আসল মিসাইলগুলো ঠেকাতে পারেনি। ইরানের দাবি মোতাবেক তারা দুটি সামরিক ঘাঁটির যথেষ্ট ক্ষতি করেছে। একটি বিমান ঘাঁটি, অন্যটি গোয়েন্দা ঘাঁটি, যেখান থেকে সিরিয়ায় ইসরায়েলি হামলা পরিচালনা করা হতো।
এর মাধ্যমে ইরান নিজের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে নিল। ইসরায়েল পড়েছে বেজায় বেকায়দায়। তারা বলছে, ৯৯ ভাগ বোমা তারা ঠেকিয়ে দিয়েছে। তাহলে তাদের উচিত, আলোচিত সেনাঘাঁটিতে সাংবাদিকদের নিয়ে গিয়ে দেখানো যে সত্যিই ক্ষতি কতটা।
ইসরায়েলের বেকায়দা দশার চিত্রটা এমন: কষে চড় খেয়েছি কিন্তু সেটা জানান দিতে পারছি না। যদি তাদের কোনো ক্ষতি না হয়ে থাকে, তাহলে ইরানে পাল্টা আক্রমণের যৌক্তিকতা কী? নেতানিয়াহুর বেকুবিতে ইসরায়েল তার প্রচলিত মিত্রদেরও ঠিকমতো পাশে আনতে পারছে না। এমনকি সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইনসহ যেসব দেশে মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে, তারা কেউই ইরানে হামলার জন্য আমেরিকাকে দেশের মাটি ব্যবহার করতে দিতে রাজি না। হামাসের হামলা ইসরায়েলের সঙ্গে আরবের স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ঠেকিয়ে দিয়েছে।
এবারের ইরানি হামলা যুক্তরাষ্ট্রকে আরবের আনুগত্য থেকে বঞ্চিত করেছে। উল্টো ইরাক বলেছে, সেখান থেকে মার্কিন সেনা সরিয়ে নিতে। এক হামাসকে মোকাবিলা করতে গিয়ে ইসরায়েল চাঙ্গা করে দিয়েছে প্রতিরোধের অক্ষশক্তিকে: ইরান, সিরিয়া, ইরাকি মিলিশিয়া, ইয়েমেনি হুতি বাহিনী, আনসারুল্লাহ এবং লেবাননের হিজবুল্লাহসহ সমগ্র অঞ্চলে ছড়ানো ইরানি নেটওয়ার্ককে।
ইসরায়েল ইরান নিয়ে মেতেছে, কারণ তাকে এখন গাজা থেকে সৈন্য সরাতে হচ্ছে। সেনাবাহিনীর ৬০ ভাগই ব্যস্ত ছিল গাজায়। একদিকে হামাসের ক্ষতি সামান্য, অন্যদিকে ছয় মাস ফিলিস্তিনি মারতে মারতে ক্লান্ত ও বিপর্যস্ত ইসরায়েলি সেনারা। মার্কিন ডলার আর অস্ত্র ছাড়া ইসরায়েল যে কিছু না, এমনকি আমেরিকার দেওয়া আয়রন ডোম, ও হাজার হাজার টন গোলাবারুদও যে গণভিত্তিক প্রতিরোধ যুদ্ধ দমাতে ব্যর্থ, ভিয়েতনামের পর সেটা প্রমাণ করছে ফিলিস্তিন।
ইসরায়েল গত কয়েক বছরে বারবার একসঙ্গে চতুর্দিকে যুদ্ধ চালানোর মহড়া দিয়েছে। কিন্তু সত্যিকার আঘাত যখন এলো, তখন তারা একেবারে অপ্রস্তুত। পশ্চিমা মিডিয়ায় যাই বলা হোক, ইসরায়েলের হিস্টিরিয়া দেখে বোঝা যায়, ইরানের হামলা তাদের স্নায়ুতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে কিন্তু তারা কিছু করতে পারছে না। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ব্রিটেন কেউই ইরান আক্রমণে রাজি না।
পারস্য সাগর একটা বোতলের মতো। এই বোতলের সরু গলা হলো ইরান নিয়ন্ত্রিত হরমুজ প্রণালি। তার কাছাকাছি বসে থাকা মার্কিন নৌবহরের পক্ষে স্বাগতিক ইরানের হামলা মোকাবিলা করা সম্ভব না। আর ইরান যদি হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেয়, বিশ্বের তেলের বাজারে ভয়ানক অস্থিরতা তৈরি হবে। দুনিয়াজুড়ে অর্থনৈতিক ঘূর্ণিঝড় বইবে, বহু লক্ষ মানুষ বেকার হবে। আর তারা সবাই দোষ দেবে ইসরায়েলকে। সুতরাং, প্রেসিডেন্ট বাইডেন ইরানে হামলার ঘোরতর বিরোধী। কারণ, তাঁর সামনে নির্বাচন এবং তিনি পুনর্নির্বাচিত হতে চান।
এসব ঘটনা ইরানকে মধ্যপ্রাচ্যের বিচক্ষণ নিরাপত্তা কুশলীর মর্যাদা দিয়েছে। গাজা, লেবানন, সিরিয়া, ইরাক ও ইয়েমেনি নিশানার মধ্যে থাকা ইসরায়েলকে আর ইরানের হামলা করার দরকার নাই। বরং লং গেইমে ইরানই আগুয়ান শক্তি, তাই নাটকীয় কিছু করার তার দরকার নাই। এক বিশ্লেষক ইরানিদের এই কৌশলকে ‘জীবন্ত ব্যাঙ সেদ্ধ করার পদ্ধতির’ সঙ্গে তুলনা করেছেন। কড়াইয়ে চড়ানো জীবন্ত ব্যাঙ পানির তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে থাকে। তাপ যত বাড়ে, ততই নিজের রক্তের উত্তাপকে তারা ভারসাম্যে আনে।
আনতে আনতে এমন অবস্থা হয় যে, যখন কড়াই ফুটতে শুরু করে তখন বেচারা ব্যাঙের আর লাফ দেওয়ার ক্ষমতা থাকে না। ব্যাঙ এভাবে জীবন্ত সেদ্ধ হয়। ব্যাঙের মৃত্যুর কারণ আসলে গরম পানি না, বিপজ্জনক পরিস্থিতি শুরুতে টের না পাওয়া। ইসরায়েল ও তার মিত্রদের হাতে সময় ছিল; কিন্তু তারা নিজেদের অজেয় মনে করেছে আফগানিস্তানে, ইরাকে এবং এখন ইউক্রেন ও ফিলিস্তিনে। এই ব্যাঙ সেদ্ধ করার পদ্ধতিটাই ইরানের মূল কৌশল। ইরান ও তার মিত্ররা মধ্যপ্রাচ্যে একটা ‘ফুটন্ত বলয়’ তৈরি করছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল যেচে যেচে সেখানে লাফিয়ে পড়েছে। অসীম ধৈর্য এবং ধীরগতির কৌশলই ইরানের আসল অস্ত্র। তারা উত্তেজিত হয় না, উস্কানিতে পা দেয় না, আঘাত হজম করে মূল পরিকল্পনা ধরে এগিয়ে যায়। তালেবানদের একটা বিখ্যাত উক্তি তাদের বেলাতেও সত্য: ‘আমেরিকানদের কাছে ঘড়ি আছে, কিন্তু আমাদের আছে সময়।’
আনসারুল্লাহ ও হুতি বাহিনী অপরাজিত কিন্তু পারস্য সাগরে মোতায়েন বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস আইজেনহাওয়ারের কমান্ডিং অফিসার ক্যাপ্টেন ক্রিস হিল গত মাসে প্রকাশ্যে বলেছেন, ‘আমাদের বিরতি দরকার, আমাদের বাড়ি যেতে হবে।’ কারণ, ইউএস নৌবাহিনীর জাহাজগুলোতে অসীম সংখ্যক ইন্টারসেপ্টর মিসাইল নেই। আর সমুদ্রের মধ্যে সেসব বার বার লোড করাও সম্ভব না। ফলে দীর্ঘমেয়াদে মার্কিন সেনাদের মনোবল ভেঙে পড়ছে। ওদিকে ইসরায়েলি অর্থনীতি ধসে যাচ্ছে।
গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ইসরায়েল থেকে ৫ লাখ নাগরিক পালিয়ে গেছে। এই বর্বরতা না থামালে আরও মানুষ দেশ ছাড়ার হুমকি দিয়েছে। মাত্র ৮৫ লাখ জনসংখ্যার এই দেশ বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক নাজুকতা নিয়ে, স্বল্প লোকবল নিয়ে এবং পশ্চিমা সমর্থনের বিপুল ঘাটতি নিয়ে কতদিন কার্যকর ‘রাষ্ট্র’ থাকতে পারবে সেটা সন্দেহ। ইরানের দেওয়া অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চলছে, তুরস্কের বাণিজ্যিক বয়কট কার্যকর। চারদিকে বৈরী প্রতিবেশী নিয়ে ফিলিস্তিন ধ্বংসের ইসরায়েলি স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্ন।
হামাসের নিরুপায় হামলার আগে ইসরায়েল-আরব মৈত্রী ছিল বাস্তবতা, ভারত থেকে ইসরায়েলের হাইফা হয়ে গ্রিস পর্যন্ত বাণিজ্যিক রুট প্রকল্প ছিল সম্ভাবনা। এভাবে ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তিকেন্দ্র হবার অভিলাষ দেখেছিল। হামাসের হামলার পর এসব স্বপ্ন কর্পূরের মতো উবে গেছে।
দিনের শেষে ময়দানে যে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, ভবিষ্যৎ তাদের। হামাস গাজায় আছে এবং তারা যুদ্ধবিরতির জন্য মরিয়া নয়। বরং যুদ্ধবিরতি দরকার পশ্চিমাদের, তারা এই ফুটন্ত কড়াই থেকে দ্রুত বেরুতে চায়। এবং ইসরায়েলের সকল বন্ধুই এখন কার্যকর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে নীতিগতভাবে রাজি। দিনের শেষে, তাহলে কে জিতছে?
লেখক; ফারুক ওয়াসিফ, সমকালের পরিকল্পনা সম্পাদক
সূত্র -সমকাল
এ এস/
Discussion about this post