পরিবারের মুখে হাসি ফুটানো ও আর্থিক স্বচ্ছলতার আশায় অনেকেই বেছে নেন প্রবাস জীবন। জীবনের শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করেও অনেকে পাড়ি জমান বিদেশে। এদের অনেকেই ভালো থাকেন। আবার অনেক ফেরেন নি:স্ব হয়ে।
পরিসংখ্যান বলছে, গত বছর থেকে প্রতি মাসে প্রায় এক লাখ কর্মী বিভিন্ন দেশে গেছেন। তবে তাঁদের মধ্যে অনেকেই গিয়ে কাজ পাচ্ছেন না। নানা কারণে তাঁরা দেশে ফিরে আসছেন। দেশে ফিরে আসা কর্মীদের মধ্যে ৩৫ শতাংশ প্রবাসী দেশটিতে গিয়ে তাঁদের কাজ পাননি বলেই ফিরে এসেছেন। ২০২০ সালের পর বিদেশে গিয়ে ফিরে আসা ২১৮ কর্মীর ওপর জরিপ চালিয়ে এ তথ্য পেয়েছে অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রামরু।
রামরুর গবেষণা বলছে, ফিরে আসা এসব কর্মীদের মধ্যে ৪২ জন নারী। গত অক্টোবর থেকে নভেম্বর সময়ের মধ্যে এ জরিপ চালায় তারা।
বৃস্পতিবার (২৩ নভেম্বর) রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত এ তথ্য তুলে ধরে রামরু।
নানা কারণে কর্মীরা দেশে ফিরে এসেছেন বলে জানিয়েছে রামরু। প্রতিবেদন বলা হয়, কাজ না পেয়ে ফিরে এসেছেন একটি বড় অংশ। এর মধ্যে বিদেশে গিয়ে কোনো কাজ পাননি ১৫ শতাংশ কর্মী। আর ২০ শতাংশ কর্মী তাঁদের চুক্তি অনুসারে কাজ পাননি। কম বেতনের জন্য ফিরেছেন ১৪ শতাংশ কর্মী। আটক হয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন ১৬ শতাংশ কর্মী। বৈধ ভিসা না থাকায় সাড়ে ১০ শতাংশ ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে ফিরে এসেছেন ১২ দশমিক ৮ শতাংশ কর্মী।
ফিরে আসা কর্মীদের কয়েকজনের ভিডিও সাক্ষাৎকার তুলে ধরা হয় অনুষ্ঠানে। এর মধ্যে সুমা আকতার নামের এক নারী বলেন, ২০২০ সালে সৌদি আরবে যান। তাঁর নিয়োগকর্তার (কফিল) চরিত্র ভালো ছিল না। তাঁকে নিয়মিত যৌন নির্যাতন করেছেন। তিনি অনেক কষ্টে ছয় মাস পার করেছেন। এরপর পালিয়ে গিয়ে দূতাবাসে আশ্রয় নিলে সরকারি ব্যবস্থাপনায় দেশে ফিরে আসেন।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য মো. সেলিম রেজা বলেন, বর্তমান প্রক্রিয়ায় লোক পাঠাতে থাকলে ফিরে আসবেই। এটা শুধু মাথা গুনে লোক পাঠানোর প্রক্রিয়া। পুরো প্রক্রিয়ার সংস্কার দরকার। বৈধভাবে বিদেশি গিয়ে কর্মী কেন কাজ পাবেন না? কাজ না থাকলে ভিসা কেন দেওয়া হলো। তারা ভিসা–বাণিজ্য করে কিন্তু স্বীকার করে না। এর জন্য সংশ্লিষ্ট দেশকে জবাবদিহি করাতে হবে।
বিএমইটির মহাপরিচালক সালেহ আহমদ মোজাফফর বলেন, তিন লাখ টাকা খরচ করে যিনি কাজ না পেয়ে ফিরে আসেন, তিনি আসলে পাচারের শিকার। এর জন্য সচেতনতা আরও বাড়াতে হবে। দালালদের জবাবদিহির আওতায় আনা যায় না। তাই জেলা প্রশাসক থেকে শুরু করে ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্র পর্যন্ত বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকা পাঠানো হচ্ছে। এতে করে কর্মীরা যাচাই করে বিদেশে যেতে পারবেন।
বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী বলেন, অধিকাংশ নারী কর্মী নানাভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। তাই বিমানবন্দরে তাঁদের বিস্তারিত তথ্য নিয়ে দূতাবাসে জানাতে হবে। দূতাবাস থেকে নিয়মিত খোঁজ রাখতে হবে, তাহলে এটি কমবে।
সরকারি মালিকানাধীন রিক্রুটিং এজেন্সি বোয়েসেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মল্লিক আনোয়ার হোসেন বলেন, দূতাবাসের মাধ্যমে নিয়োগকর্তা কোম্পানির সব তথ্য যাচাই–বাছাই করে চুক্তি করা হয়। তাই বোয়েসেল থেকে পাঠানো কর্মীরা অসুস্থতা ছাড়া ফিরে আসেন না। তবে ৯৯ শতাংশ কর্মী পাঠায় বেসরকারি খাত। তাদের জন্য যাচাই করা কঠিন।
রামরুর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফিরে আসা কর্মীদের সবাই অদক্ষ শ্রমিক। বিদেশে গিয়ে নির্মাণ অবকাঠামো, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, গৃহকর্মী, দৈনিক শ্রমিক, কৃষি ও কাঠমিস্ত্রির কাজ করেছেন তাঁরা। মাত্র ৩ শতাংশ কর্মী স্বেচ্ছায় ফিরে এসেছেন। আর যাঁরা আটক হয়ে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁদের ৪৭ শতাংশের বৈধ কাজের অনুমতিপত্র (ইকামা) ছিল না। আগে ফিরে আসায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও দেশে ফিরে ৭২ শতাংশ ব্যক্তি কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি। তাঁদের মধ্যে অনেকেই ফিরে এসে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে গেছেন। তবে এ জরিপে একটা ক্ষেত্রে কিছুটা উন্নতি দেখা গেছে। একসময় বিদেশফেরত কর্মীরা শুধু দালালের নাম বলতেন। এখন সাড়ে ১৫ শতাংশ কর্মী তাঁদের এজেন্সির নামও বলেছেন। ৭৪ শতাংশ কর্মী বলেছেন দালালের মাধ্যমে যাওয়ার কথা।
সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো–অপারেশন ও হেলভেটাসের সহায়তায় গবেষণাটি করেছে রামরু। অনুষ্ঠানে অভিবাসন নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধিরা বিভিন্ন পরামর্শ দেন। এতে নিবন্ধ উপস্থাপনার পাশাপাশি সঞ্চালনা করেন রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনিম সিদ্দিকী।