অনিয়মের মাধ্যমে এলসির ডলার ছাড় এবং তা বিদেশে পাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যাংক কর্মকর্তা মো. সামসুল আলম। পণ্যের জাহাজীকরণের আগেই গ্রাহকের ডলার ছাড় করেছেন তিনি।এ জন্য ঋণপত্র (এলসি) যাচাইয়ের কাজটুকুও করেননি । এর মধ্য দিয়ে ডলার পাচার হয়েছে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল।
বর্তমানে সামসুল আলম অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডের (এবিএল) ক্রেডিট বিভাগের (ঋণ শাখা) মহাব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত। তার আগে ছিলেন একই ব্যাংকের বৈদেশিক বাণিজ্য করপোরেট শাখার প্রধান। ওই সময়টাতেই তিনি নিয়মের খুব একটা তোয়াক্কা না করে বিভিন্ন গ্রাহকের সঙ্গে যোগসাজশে অনিয়মে জড়ান বলে অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে সিকোটেক্স ফ্যাব্রিক্স লিমিটেডের সঙ্গে এলসি জালিয়াতির বিষয়টি তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী, সামসুল আলম ২০২০-২১ সালে অগ্রণী ব্যাংকের বৈদেশিক বাণিজ্য করপোরেট শাখায় কর্মরত ছিলেন। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে তাঁর বিরুদ্ধে অনিয়মের প্রমাণ পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখানে উল্লেখ করা হয় যে সামসুল আলম পণ্য জাহাজীকরণের আগে বিল যাচাই (বিল অব লেডিং) ছাড়াই কয়েক লাখ ডলার দিয়ে রপ্তানি বিল কিনে গ্রাহক সিকোটেক্স ফেব্রিক্সকে অনৈতিক সুবিধা দেন। সেই অর্থ রপ্তানি বিল কেনায় ব্যবহৃত হয়নি, কৌশলে আত্মসাৎ করা হয়েছে। এই অর্থ পাচার হয়েছে বলে সন্দেহ বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শকদের।
শুধু বাংলাদেশ ব্যাংক নয়, অগ্রণী ব্যাংকের অডিট কমিটিও সামসুল আলমের বিরুদ্ধে এলসি জালিয়াতির প্রমাণ পেয়েছে। এ জন্য ৯ নভেম্বর সামসুল আলমকে তলব করেছে তারা।
অভিযোগের বিষয়ে সামসুল আলমের সঙ্গে গত রোববার দেখা করলে তিনি ডলার পাচারের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তবে এলসি যাচাই ছাড়াই ডলার ছাড়াটা ভুল হয়েছে বলে স্বীকার করেছেন।
সামসুল আলম বলেন, ‘করোনাকালে অনেক কিছু স্বাভাবিক ছিল না। সিকোটেক্স ফ্যাব্রিক্স আমাদের ৩৬ বছরের পুরোনো গ্রাহক। তার অন্য কোনো ব্যাংকে হিসাবে নেই। এসব ভেবে গ্রাহকের ওপর আস্থা রেখে পণ্য জাহাজীকরণ ছাড়াই রপ্তানি বিল কেনা হয়। এটা ব্যাংক ও দেশের স্বার্থে করা হয়েছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক পরিদর্শন দল ও অগ্রণী ব্যাংকের অডিট কমিটির তদন্তে একে অপরাধ হিসাবে দেখছে। তবে পুরোনো ইস্যু ব্যাংকের ভেতরের দুষ্ট কিছু লোক সামনে এনেছে। চিঠি পেয়ে জবাবে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছি। এখন বিষয়টি কর্তৃপক্ষের ওপর নির্ভর করছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিকোটেক্স ফেব্রিক্স নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে অবস্থিত। কোম্পানির সুনাম রয়েছে। কোম্পানির পণ্য ইউরোপীয় দেশসমূহ এবং যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করে।
সিকোটেক্স ফেব্রিক্সের জেনারেল ম্যানেজার মো. আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, ‘আমরা অগ্রণী ব্যাংকের পুরোনো গ্রাহক। আমাদের পণ্য আমেরিকা ও ইউরোপে রপ্তানি করা হয়। মাসে প্রায় ৫-৬ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। আর এলসি জালিয়াতির বিষয় কিছুই জানি না।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অগ্রণী ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, সামসুল আলম সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সময়ে সর্বেসর্বা ছিলেন। কেউ তাঁর বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারতেন না। তাঁর বিরুদ্ধে অনেক আপত্তি সত্ত্বেও মহাব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এখন তিনি আগের এমডির বদনাম করে বর্তমান এমডির প্রিয়ভাজন হয়ে ঋণ বিভাগে বহাল তবিয়তে রয়েছেন।
এ বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক এমডি মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম বলেন, ‘আমি ব্যাংকে আমূল পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়েছি। গত বছর বিদায় নিয়েছি। যদি কোনো দুষ্ট কর্মকর্তা নিজের অপরাধ আড়াল করতে আমাকে জড়ানোর অপচেষ্টা করেন, তা শতভাগ অনৈতিক। এ ধরনের কর্মকর্তা ব্যাংক, গ্রাহক—সবার জন্য ক্ষতিকর। অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা ব্যাংকের দায়িত্ব।’
সামসুল আলমের অপরাধের বিষয়ে জানতে অগ্রণী ব্যাংকে গিয়ে বর্তমান এমডি মো. মুরশেদুল কবীরের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি সাক্ষাৎ দেননি। পরে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কল কেটে দেন। খুদে বার্তা পাঠালে তা দেখলেও জবাব দেননি।
উল্লেখ্য, চলতি বছর অগ্রণী ব্যাংকের মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুর শাখার ব্যবস্থাপক আরকানুল হক এলসি মার্জিনের ১৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তিনি অন্তত ১৬টি এলসি পণ্যের দাম (৯ কোটি টাকার বেশি) পরিশোধ করেননি। অপরদিকে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে অগ্রণী ব্যাংকের প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ টাকার ঋণ জালিয়াতি করেছেন ব্যাংকটির বরখাস্তকৃত শাখা ব্যবস্থাপক শৈলেন বিশ্বাসসহ চার কর্মকর্তা-কর্মচারী।
Discussion about this post