মসজিদুল আকসা মুসলমানদের প্রথম কিবলা। কাবা ও মসজিদে নববীর পর এই মসজিদের মর্যাদা। ইসলামের অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে এই মসজিদ ঘিরে। মসজিদুল আকসা মুমিনের অনুপ্রেরণার নাম। এ মসজিদের নাম শুনলে আমরা যতটা আপ্লুত হই, অন্য কোনো মসজিদের নাম শুনলে ততটা হই না।
মসজিদুল আকসার সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রিয় নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মেরাজের ঘটনা। কোরআন-সুন্নাহর দলিলের আলোকে মসজিদুল আকসার ১১টি অনন্য তাৎপর্য ও বৈশিষ্ট্য থাকছে এই প্রতিবেদনে,
প্রথম কিবলা
মুসলমানরা কিবলার দিকে তাকিয়ে আমরা নামাজ আদায় করেন, মসজিদুল আকসা মুসলমানদের প্রথম কিবলা।
ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ে নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর যখন নামাজ ফরজ হয়, তখন তিনি ও সাহাবিরা মসজিদুল আকসার দিকে ফিরে নামাজ আদায় করতেন। মদিনায় হিজরতের পরও ষোল/সতেরো মাস পর্যন্ত কিবলা ছিল মসজিদুল আকসা। পরবর্তীতে নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আকাঙ্ক্ষার প্রেক্ষিতে মহান আল্লাহ বাইতুল্লাহকে কিবলা নির্ধারণ করেন।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন,
‘নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় থাকাকালীন কাবাকে সামনে রেখে জেরুজালেমের দিকে ফিরে নামাজ আদায় করতেন। মদিনায় হিজরতের পরও ১৬ মাস পর্যন্ত এভাবে নামাজ আদায় করেছেন। এরপর কিবলা কাবার দিকে ফিরিয়ে দেয়া হলো। (বুখারি: ৪০) ‘
আরও পড়ুনঃ চা দেশের মানুষের আর্থিক সচ্ছলতা এনেছে: প্রধানমন্ত্রী
কোরআন-স্বীকৃত পবিত্র ভূমি
মসজিদুল আকসা এবং আশপাশের এলাকাকে পবিত্র কোরআনে পবিত্র ভূমি আখ্যা দেয়া হয়েছে। এটাও মসজিদুল আকসার অনন্য বৈশিষ্ট্যের একটি। এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন,
‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রি বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার চারদিকে আমি বরকত দান করেছি, যাতে আমি তাকে আমার নিদর্শনসমূহ দেখিয়ে দেই। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা। (সুরা ইসরা: ০১)’
মেরাজের সূচনাস্থল
ইসরা ও মেরাজের সফর নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের বিস্ময়কর ঘটনা ও আল্লাহর নিদর্শন। বায়তুল্লাহ থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত ভ্রমণকে ইসরা এবং মসজিদুল আকসা থেকে ঊর্ধ্বাকাশের ভ্রমণকে বলা হয় মেরাজ। সেই হিসেবে নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মেরাজের সূচনা হয়েছিল মসজিদুল আকসা থেকে। এ কারণে বলা যায়, মসজিদুল আকসা নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মেরাজের সূচনাস্থল।
মেরাজের ঘটনা উল্লেখ করতে গিয়ে নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমার জন্য বুরাক আনা হলো। বুরাক হলো গাধা থেকে বড় এবং খচ্চর থেকে ছোট একটি সাদা রঙের প্রাণী। দৃষ্টির শেষ সীমায় তার পদক্ষেপ পড়ে। নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি এতে আরোহণ করলাম এবং বাইতুল মাকদিসে (মসজিদুল আকসা) পৌঁছলাম। অতঃপর নবীরা তাদের বাহনগুলো যে খুঁটির সাথে বাঁধতেন, আমি সে খুঁটির সাথে আমার বাহনটি বাঁধলাম। তারপর মসজিদে প্রবেশ করলাম এবং দু রাকাত নামাজ আদায় করে বের হলাম (মুসলিম: ১৬২)
নবী-রসুলদের স্মৃতির স্মারক
মহান আল্লাহ মসজিদুল আকসা ও তার আশেপাশে যত নবী-রসুল পাঠিয়েছেন, অন্য কোনো অঞ্চলে এতো বেশি নবী-রসুল পাঠাননি। অনেক নবী-রসুল এমন ছিলেন, যারা ভিন্ন অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেছেন, পরবর্তীতে মহান আল্লাহর আদেশে এই মসজিদের জনপদে হিজরত করেছেন। সেই হিসেবে এই অঞ্চলটিকে নবী-রসুলদের স্মৃতির স্মারক বলা যায়।
ইবরাহিম (আ.) ও লুত (আ.)-এর হিজরতের ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,
‘এবং আমি তাকে (ইবরাহিম) ও লুতকে উদ্ধার করে এমন এক ভূমিতে নিয়ে গেলাম, যেখানে আমি পুরো বিশ্ববাসীর জন্য বরকত রেখেছি। (সুরা আম্বিয়া: ৭১)’
মসজিদুল আকসা পৃথিবীর দ্বিতীয় মসজিদ
আমরা জানি, এই পৃথিবীতে নির্মিত প্রথম ঘর বায়তুল্লাহ, যা মক্কায় অবস্থিত। এটা একদিকে যেমন পৃথিবীর প্রথম ঘর অপরদিকে এটা পৃথিবীর প্রথম মসজিদ। এরপর যে মসজিদটি নির্মিত হয়- তা হলো মসজিদুল আকসা।
হযরত আবু যর গিফারী (রা.) হতে বর্ণিত হাদিসে আছে, আমি বললাম,
‘হে আল্লাহর রসুল, পৃথিবীতে সর্বপ্রথম কোন মসজিদ তৈরি করা হয়েছে? তিনি বললেন, মসজিদুল হারাম। বললাম, অতঃপর কোনটি? তিনি বললেন, মসজিদুল আকসা। বললাম, উভয় মসজিদের মাঝে কত সময়ের ব্যবধান ছিল? তিনি বললেন, চল্লিশ বছর। (বুখারি: ৩৩৬৬)’
আরও পড়ুনঃ অভিযোগ দিতে পারবেন মালয়েশিয়ায় যেতে না পারা কর্মীরা
মসজিদুল আকসার উদ্দেশে ভ্রমণ ইবাদত
এই পৃথিবীতে তিনটি মসজিদ ব্যতীত যত মসজিদ আছে, ইসলামের চোখে সবই সমান। সেই তিনটি মসজিদ হলো বায়তুল্লাহ, মসজিদে নববী এবং মসজিদুল আকসা। এই তিনটি মসজিদের পর পৃথিবীতে আর কোনো মসজিদের একটির ওপর অপরটির ফজিলত নেই। এমনকি কোনো মসজিদকে গুরুত্বপূর্ণ ভেবে সওয়াবের নিয়তে ভ্রমণ করাও জায়েজ নেই। তবে উল্লিখিত তিনটি মসজিদকে বরকতময় ভেবে সে উদ্দেশে ভ্রমণ করা সওয়াবের কাজ। এটাও মসজিদুল আকসার একটি বৈশিষ্ট্য।
নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘মসজিদুল হারাম, মসজিদুর রসুল এবং মসজিদুল আকসা এই তিনটি মসজিদ ছাড়া অন্য কোনো মসজিদে নামাজের উদ্দেশে হাওদা বাঁধা যাবে না (অর্থাৎ সফর করা যাবে না)। (বুখারি: ১১৮৯)’
এক রাকাতে ২৫০ রাকাতের সওয়াব
মসজিদুল আকসা এতটাই বরকতপূর্ণ এবং ফজিলময় স্থান, সেখানে কেউ এক রাকাত নামাজ পড়লে ২৫০ রাকাত নামাজের সওয়াব হয়। হযরত আবু যর গিফারী (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, আমরা তখন নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আলোচনা করছিলাম, আমরা তার কাছে জানতে চাইলাম- কোনটি উত্তম, নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মসজিদ নাকি বায়তুল মাকদিসের মসজিদ? তখন নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমার এই মসজিদে একটি নামাজ সেখানকার চারটি নামাজের চেয়ে উত্তম। (মুসতাদরাক হাকিম: ৮৬০০)
এই হাদিসে বোঝা যাচ্ছে, মসজিদে নববীর দুই রাকাত নামাজ এক হাজার রাকাতের সমান। আর এক হাজারের এক চতুর্থাংশ হলো ২৫০। অর্থাৎ মসজিদুল আকসার দুই রাকাত নামাজ ২৫০ রাকাত নামাজের সমতুল্য।
গুনাহ মাফের স্থান
মসজিদুল আকসার একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এটি গুনাহ মাফের জায়গা। কেউ যদি নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদুল আকসায় গমন করে, তবে মহান আল্লাহ তার গুনাহ মাফ করে দেন।
মসজিদুল আকসার নির্মাণকাজ শেষ করার পর সুলাইমান (আ.) মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন, ‘যে ব্যক্তি এই মসজিদে নামাজ আদায়ের জন্য আসবে, সে যেন গুনাহ থেকে সেদিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে যায়, যেদিন তার মা তাকে জন্ম দিয়েছিল।’
‘আর নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, মহান আল্লাহ তার নবী সুলাইমান (আ.)-এর এই দোয়া কবুল করবেন। (মুসনাদে আহমদ: ৬৬৪৪)’
শেষ যামানার মানুষের পরম কাঙ্ক্ষিত ভূমি
আমরা জানি, নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন সময়ে নানা রকম ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। মসজিদুল আকসা সম্পর্কেও তার অনেকগুলো ভবিষ্যদ্বাণী আছে।
তার একটি ভবিষ্যদ্বাণী থেকে জানা যায়, শেষ যামানায় মসজিদুল আকসা মুসলমানদের কাছে এত প্রিয় হয়ে উঠবে, মসজিদুল আকসাকে দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখা যায়, এমন এক টুকরো ভূমি তাদের কাছে পৃথিবীর সবকিছু থেকে প্রিয় ও মূল্যবান হয়ে উঠবে।
এ ব্যাপারে নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘খুব শিগগিরই এমন হবে যে, একজন মানুষের জন্য তার ঘোড়ার রশির দৈর্ঘ্য পরিমাণ ভূমি, যেখান থেকে বায়তুল মাকদিস দেখা যায়, সেটা তার কাছে সমগ্র দুনিয়া থেকে উত্তম হবে, অথবা দুনিয়া ও দুনিয়ার মাঝে যা কিছু আছে তার থেকে উত্তম হবে। (মুসতাদরাক হাকিম: ৮৫৫৩)’
আরও পড়ুনঃ আজ বিক্রি হচ্ছে ১৪ জুনের ট্রেনের টিকিট
ইয়াজুজ-মাজুজের ধ্বংসস্থল
কেয়ামতের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটবে মসজিদুল আকসা ও তার আশপাশের ভূমিতে। কেয়ামতের বড় বড় প্রসিদ্ধ ১০টি আলামতের একটি হলো ইয়াজুজ-মাজুজের আবির্ভাব। এই ইয়াজুজ-মাজুজ ধ্বংস হবে মসজিদুল আকসার পার্শ্ববর্তী একটি পাহাড়ে।
ইয়াজুজ-মাজুজের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এরপর তারা (ইয়াজুজ-মাজুজ) অগ্রসর হতে থাকবে। পরিশেষে তারা জাবালে খামার নামক একটি পাহাড়ে গিয়ে পৌঁছবে। জাবালে খামার হলো, বাইতুল মাকদিসের একটি পাহাড়। সেখানে পৌঁছে তারা বলবে, আমরা তো পৃথিবীবাসীকে ধ্বংস করে দিয়েছি। এসো, আকাশমণ্ডলীর সত্তাকেও ধ্বংস করে দিই। এই বলে তারা আকাশের দিকে তীর ছুড়তে থাকবে। মহান আল্লাহ তাদের তীরগুলোকে রক্তে রঞ্জিত করে তাদের প্রতি ফিরিয়ে দেবেন। হাদিসের শেষাংশে আছে, অতঃপর আল্লাহর নবী ঈসা (আ.) এবং তার সঙ্গীগণ আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন। ফলে মহান আল্লাহ তাদের ঘাড়ে এক প্রকার কীট সৃষ্টি করে দেবেন। যার শিকার হয়ে তারা এক সঙ্গে সবাই মারা যাবে। (মুসলিম: ২৯৩৭)
দাজ্জাল থেকে মুক্ত
কেয়ামতের আগে দাজ্জাল যখন গোটা পৃথিবী জুড়ে তাণ্ডব চালাবে এবং দুর্বল ঈমানদাররা দলে দলে দাজ্জালের ফেতনায় আপতিত হবে, সেই কঠিন সময়েও মসজিদুল আকসা থাকবে দাজ্জালের ফেতনা থেকে মুক্ত।
এ ব্যাপারে নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘দাজ্জাল চারটি মসজিদে প্রবেশ করতে পারবে না: মসজিদুল হারাম, মসজিদুন নববী, মসজিদুত তুর এবং মসজিদুল আকসা। (মুসনাদে আহমাদ: ২৩৬৮৫)’
এ এ/
Discussion about this post