প্রতিনিয়তই ঘটছে মানব পাচারের ঘটনা। অভিযুক্তরা গ্রেফতারও হচ্ছে। তদন্ত শেষে চার্জশিটও দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বেশিরভাগ অভিযুক্তকে বিচার শেষে দোষী সাব্যস্ত করা হয় না এবং খুব কমই শাস্তি দেওয়া হয়। ২০২১ বা ২০২২ সালে একটিও মামলায় অভিযুক্তদের সাজা হয়নি। মানবপাচার মামলার এই করুণ অবস্থার কারণে বিশেষ নির্দেশনা জারি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মামলার তদন্ত যথাযথ প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করার জন্য একটি নির্দেশিকা তৈরি করা হয়েছে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের তা পালন করতে বলা হয়েছে। কিন্তু চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৫৭ জন আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে এবং দুইজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানবপাচারের অপরাধগুলোতে মূলত ছয়টি পর্যায় বিদ্যমান থাকে। এগুলো হচ্ছে—ভিকটিম সংগ্রহ, পরিবহন বা স্থানান্তর, গন্তব্যস্থল, শোষণ বা নিপীড়ন, উদ্ধার, প্রত্যাবাসন বা বাড়ি ফিরে আসা। তদন্তের সময় এ বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে অনুসন্ধান করতে বলা হয়েছে।
নির্দেশিকায় উল্লেখ করা হয়—ভিকটিমের সাথে কীভাবে যোগাযোগ করা হয়েছিল, কোন ব্যক্তি যোগাযোগ করেছিল, তার সঙ্গে ভিকটিম বা ভিকটিমের অভিভাবকের কীভাবে পরিচয় হয়েছিল বা কীভাবে তার সংস্পর্শে এসেছিলেন। ভিকটিম বা তার অভিভাবককে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি বা আর্থিক বা অন্য কোনও সুবিধা প্রদান করে প্রতারণা বা ছলনার মাধ্যমে তাদের সম্মতি গ্রহণপূর্বক ভিকটিমকে সংগ্রহ করা হয়েছিল কিনা, তার বিস্তারিত তথ্য জানতে বলা হয়েছে। এছাড়া ভিকটিমকে ভয়ভীতি দেখিয়ে, বল প্রয়োগ বা অপহরণ কিংবা তার কোনও অসহায়ত্বকে কাজে লাগিয়ে পাচার করা হয়েছে কিনা— এমন সব তথ্যও সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে।
পরিবহন বা স্থানান্তরের ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য, পরিবহনের মাধ্যম, পথের বর্ণনা, কত সময় ধরে ভ্রমণ, ভ্রমণকালীন সঙ্গী, ভ্রমণের খরচ বহন, কাগজপত্র বা ডকুমেন্টসের ব্যবহার বা চাকরির চুক্তিপত্র, প্রশিক্ষণ দেওয়া বা গ্রুমিং করানো, ধরা পড়লে পুলিশ, বর্ডার গার্ড বা ইমিগ্রেশন পুলিশকে কী বলতে হবে তা শিখিয়ে দেওয়া, সীমান্ত পেরিয়ে গেলে কোন সীমান্ত, কবে, কখন, কীভাবে সীমান্ত পার হয়েছেন তার বর্ণনা, সীমান্ত পার হওয়ার আগে ও পরে কারও আশ্রয়ে ছিলেন কিনা, ভ্রমণ বা আশ্রয়ে থাকার সময় আরও কোনও ভিকটিম ছিলেন কিনা, শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে।
নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, ভিকটিমকে চাকরির প্রতিশ্রুতি দেয়া হলে গন্তব্যস্থলে তাকে কাঙ্ক্ষিত চাকরি দেওয়া হয়েছে কিনা, কাজ বা চাকরির জন্য জোর করা হয়েছে কিনা, ভিকটিমকে কখনও বিক্রি করা হয়েছিল কিনা এবং শ্রম, যৌন বা অন্য কোনও ধরনের শোষণের শিকার হয়েছে কিনা, এসব বিস্তারিত অনুসন্ধান করতে হবে। এছাড়াও জোর করে ভিক্ষাবৃত্তি, মাদক সেবনে বাধ্য করা, চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা, জীবননাশের হুমকি, খাবার খেতে না দেওয়া, ভ্রমণের কাগজপত্র আটকে রাখা, জোর করে পতিতাবৃত্তি করানো, দাস হিসেবে ব্যবহার, জোর করে বিনোদন ব্যবসায় ব্যবহার করা ইত্যাদি বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে তদন্ত সম্পন্ন করতে হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাতে জানা গেছে, ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সাড়ে ছয় হাজার মামলা তদন্তাধীন ছিল। এর মধ্যে ৩৬৬টি মামলায় অভিযোগপত্র ও ৪০টি মামলায় চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়া হয়। কিন্তু পুরো বছরে বিচার শেষে একজনেরও সাজা হয়নি। বরং দুটি মামলার বিচার শেষে পাঁচ জন আসামি খালাস পেয়েছেন। ২০২২ সালেও একজন আসামিরও সাজা হয়নি। গত বছর ৬৪টি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। চারটি মামলায় চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। গত বছর ২৭টি মামলার বিচার শেষ হয়েছে। সব মামলার আসামিরাই খালাস পেয়েছে। তবে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ২৪৬টি মামলায় চার্জশিট ও ১২৯টি মামলায় চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫৭ জন আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ড দেওয়া হয়েছে। এর বিপরীতে এক হাজার ২৭৯ জন আসামি খালাস পেয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন কর্মকর্তা জানান, যেকোনও মামলার যথাযথভাবে বিচার সম্পন্ন হওয়ার ক্ষেত্রে তদন্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তদন্ত ও অভিযোগপত্রে কোনও ফাঁকফোকর থাকলে অপরাধীরা আদালত থেকে ছাড়া পেয়ে যায়। এজন্যই মানবপাচার মামলায় আসামিদের সাজার চেয়ে খালাসের হার অনেক বেশি।
‘মানবপাচারের ঘটনাগুলো আন্তদেশীয় অপরাধ। ফলে মামলার তদন্তের সময় দেশের ভেতরের অংশটি যথাযথ তদন্ত সম্পন্ন করা গেলেও বাইরের অংশটি অনুদ্ঘাটিত থেকে যায়। তারপরও আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বিচারিক প্রক্রিয়ায় গিয়ে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ না হওয়ায় আসামিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছে।’ জানান, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন।
পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্ব পালনকারী এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আদালতে মানবপাচারের মামলাগুলোর বিচার চলাকালীন দেশের ভেতর থেকে সাক্ষী পাওয়া যায়, কিন্তু বিদেশে অবস্থানরত সাক্ষীরা কেউ সাক্ষ্য দিতে আসেন না। আন্তদেশীয় অপরাধ হওয়ায় এসব মামলার তদন্ত করা যেমন কঠিন, তেমনই বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করাও কঠিন। তারপরও আমরা তদন্তের ক্ষেত্রে আরও সুনিপুণভাবে করার জন্য মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন গাইডলাইন মেনে অনুসন্ধান করার কথা বলেছি। আশা করছি, মানবপাচার মামলায় সাজার হার আরও বাড়বে।’
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন
Discussion about this post