কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত ও সহিংসতার প্রেক্ষাপটে আইন প্রয়োগকারী অভিযানের সময় হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানোর ঘটনা ঘটেনি। মূলত নজরদারি, নির্দিষ্ট স্থানে আটকা পড়া আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মীদের উদ্ধার এবং জরুরি পরিস্থিতিতে অগ্নিনির্বাপক সুবিধা দেওয়ার জন্য এটি ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সরকার।
সূত্র জানায়, শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনে ঢুকে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী দুর্বৃত্তদের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে এরই মধ্যে তাদের সম্পর্কে খোঁজ নিতে শুরু করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। সংঘর্ষের সময় অনেক দুর্বৃত্তের হাতে অস্ত্র থাকার দৃশ্য ক্যামেরায় ধরা পড়েছে। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, এরা জামায়াত-শিবির ও নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাওহীদের সদস্য। এরাই বিভিন্ন বাসা-বাড়ির ছাদ থেকে সড়কে আন্দোলন নিয়ন্ত্রণকারী আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে।
এ নিয়ে সাধারণ মানুষও পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছে। পুলিশ ও র্যাব সূত্র বলেছে, সংঘর্ষের সময় বিভিন্ন বাসা-বাড়ির ছাদে, বারান্দা ও জানালায় যেসব গুলি ছোড়া হয়েছে, সেগুলো দুর্বৃত্তদের টার্গেট করা গুলি। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর প্রশিক্ষিত সদস্যের গুলি কখনো কারো বাসা-বাড়ির ছাদে, বারান্দায় কিংবা জানালায় যেতে পারে না। এসব গুলি কারা ছুড়েছে তা খতিয়ে দেখছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে ঢুকে রাষ্ট্রের বহু স্থাপনায় নাশকতা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এ বিষয়ে একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, নাশকতাকারীদের ঠেকাতে পুলিশ, র্যাব, আনসার, বিজিবিসহ অন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা সর্বোচ্চ পেশাদারির সঙ্গে লড়ে গেছেন। দুর্বৃত্তদের হাত থেকে জনগণের জানমাল ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে মারাও গেছেন দুজন পুলিশ ও একজন আনসার সদস্য। আহত হয়েছেন ১১ শতাধিক পুলিশ সদস্য। উদ্ভূত ওই পরিস্থিতিতে পুলিশও গুলি ছোড়ে।
অন্যদিকে র্যাব সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়, শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনে জনগণের জানমালের ক্ষতি ও ধ্বংসযজ্ঞ প্রতিরোধ করতে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে র্যাবের হেলিকপ্টার থেকে টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়েছে। কোনোভাবেই হেলিকপ্টার থেকে কোনো প্রকার গুলি বা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি। কিন্তু এ নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস বলেন, আন্দোলনে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা ও নাশকতা সৃষ্টিকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে হেলিকপ্টার থেকে কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়েছে। কোনো ধরনের গুলি বা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি।
তিনি আরো বলেন, দুর্বৃত্তদের হাত থেকে জনগণের জানমাল ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ বাঁচাতে সর্বোচ্চ পেশাদারি নিয়ে কাজ করেছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা। সহিংসতার সময় দুর্বৃত্তরা বিভিন্ন বাসা-বাড়ির ছাদে, বারান্দায় ও জানালায় গুলি ছুড়েছে। কারণ কোনো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যের গুলি এভাবে এলোপাতাড়ি বাসা-বাড়ি কিংবা কারো বাড়ির বারান্দা, জানালা কিংবা ছাদে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১৮ থেকে ২০ জুলাই এই তিন দিন কোটা আন্দোলনের আড়ালে সর্বাধিক নাশকতা চালানো হয়। ওই সময় রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, উত্তরা, বাড্ডা, রামপুরা, মোহাম্মদপুরসহ পাশের জেলা নারায়ণগঞ্জে অনেক বাসা-বাড়ির ছাদে, বারান্দা ও জানালায় গুলি ছোড়া হয়েছে। এসব গুলি শিশুসহ অন্য বয়সীদেরও কারো মাথায়, চোখে, পায়ে এবং হাতে লেগেছে। এতে অনেকে গুরুতর আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে মধ্যবাড্ডা এলাকার বাসিন্দা মেরাজ মিয়া বলেন, পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে কোথা থেকে গুলি এসে বাসা-বাড়িতে ঢুকছে তা আঁচ করা যাচ্ছিল না। যেন চোরাগোপ্তা হামলা। এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে এবং জানমালের ক্ষতি করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও সরকারের ওপর দায় চাপাতে দুর্বৃত্তরা এটা করে থাকতে পারে। কারণ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর যদি গুলি ছুড়তে হয়, ছুড়বে নাশকতাকারীদের লক্ষ্য করে। কারো বাসা-বাড়ি লক্ষ্য করে নিশ্চয় না।
পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের পুলিশ সুপার এনামুল হক সাগর বলেন, ‘সারা দেশ থেকেই নাশকতাকারীদের ভিডিও এবং ছবিসহ অন্য তথ্য সংগ্রহ করছে পুলিশ। নির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে নাশকতাকারীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। প্রকৃত নাশকতাকারীরা কেউ আইনের হাত থেকে ছাড় পাবে না।’
নাশকতাকারীদের বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের পর তাদের জিজ্ঞাসাবাদে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা জানতে পারেন, নাশকতাকারীরা জামায়াত-শিবির ও বিএনপির নেতাকর্মী। সরকার হটাতে অনেক আগে থেকে তারা এই পরিকল্পনা করে আসছিল। প্রথমে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে ঢুকে বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা করে, এরপর ভারতীয় পণ্য বর্জন ও সর্বশেষ কোটা সংস্কার আন্দোলনে ঢুকে তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে চেয়েছিল। বিভিন্ন সময় বিশৃঙ্খলার ছবি ও ভিডিও সরকারবিরোধীসহ বিতর্কিত ইউটিউবারদের কাছে পাঠানো হতো। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য বারবার ব্যর্থ হয়েছে।
এই উদ্দেশ্য নিয়ে দেশে-বিদেশে কাজ করছে কয়েক শ লোক। এদের অর্থের জোগান দেওয়া হয় দেশের বাইরে থেকে। এবারের কোটা সংস্কার আন্দোলনেও তারা রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে ছবি ও ভিডিও ধারণ করেছে বিদেশে বিএনপি-জামায়াতের লোকজনসহ অন্যদের পাঠানোর উদ্দেশ্যে।
অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, নাশকতাকারীরা নিজেরা গুলি করে লাশ ফেলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এমনটি করতে পারে। এ জন্য প্রতিটি মরদেহের ময়নাতদন্তসহ গুলিবিদ্ধ আহতদের বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত হলে বেরিয়ে আসবে কোনটা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর গুলি, আর কোনটা নাশকতাকারীদের গুলি।
এস এম/
Discussion about this post