স্বাধীনতার ৫০ বছরের মধ্যেই মাথাপিছু জিডিপিতে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বড় শক্তির দুটি দেশ ভারত ও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে দিল বাংলাদেশ। আয়ের ক্ষেত্রে কয়েক বছর ধরেই ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। ভারত ও পাকিস্তানের মানুষের চেয়ে গড়ে বাংলাদেশের মানুষেরা বেশি আয় করেন। এটি দেশের অভ্যন্তরে তাঁদের আয়ের হিসাব। অথচ দুই দশক আগেও ভারত ও পাকিস্তান বেশ এগিয়ে ছিল বাংলাদেশের চেয়ে।
স্বাধীনতার পরপর বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। দুই দশক ধরে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অনেক ক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। এই তালিকায় আছে গড় আয়ু, সাক্ষরতার হার, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব অনুযায়ী, দেশের অভ্যন্তরে মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে টানা চার বছর ধরে ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। আর এ ক্ষেত্রে টানা আট বছর ধরে পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) এখন ২ হাজার ৬২১ ডলার। অন্যদিকে ভারতের ২ হাজার ৬১২ ডলার এবং পাকিস্তানের ১ হাজার ৪৭১ ডলার।
এ বিষয়ে সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, দেড় দশক ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অগ্রগতির সুফল মিলেছে। কোভিডের আগপর্যন্ত স্থিতিশীলভাবে অর্থনীতি এগিয়েছে। শুধু মাথাপিছু আয় নয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়নের অনেক ক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় এখন বাংলাদেশের অর্ধেকের কিছুটা বেশি। মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকে ছাড়িয়েছি কোভিডের সময়। তিনি আরও বলেন, গত দেড় দশকে পরিকল্পনার সঙ্গে বাজেট করা হয়েছে। প্রবৃদ্ধির হার, কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ, অবকাঠামো উন্নয়নসহ সবকিছুই পরিকল্পনামাফিক করা হয়েছে। এর সুফল মিলছে এখন।
মাথাপিছু আয় ও মাথাপিছু জিডিপি কী
একটি দেশের অভ্যন্তরে যত উৎপাদন ও সেবা সৃষ্টি হয়, তা ওই দেশের সব মানুষকে সমভাবে ভাগ করে দিলে মাথাপিছু জিডিপি হয়। এ আয়ে প্রবাসী আয়সহ দেশের বাইরের আয় যুক্ত হয় না। প্রবাসী আয় ও দেশের বাইরের আয় যুক্ত হলে সেটিকে মাথাপিছু জিডিপি না বলে মাথাপিছু আয় বলা হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয়ের ৯৬ শতাংশই আসে দেশের অভ্যন্তর থেকে।
এক দশকে মাথাপিছু আয়ু দ্বিগুণ করেছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ হিসাবে, এখন মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৭৬৫ ডলার। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৩১৬ ডলার। গত এক দশকে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে দ্রুতগতিতে মাথাপিছু আয় বেড়েছে বাংলাদেশে।
৪ বছর ধরে ভারতের ওপরে বাংলাদেশ
মাথাপিছু জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) ক্ষেত্রে টানা চার বছর ধরে ভারতের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। আইএমএফের সর্বশেষ হিসাবে, ২০২৩ সালে এসে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু জিডিপি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬২১ ডলার। আর ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ২ হাজার ৬১২ ডলার।
২০২০ সালে প্রথমবারের মতো মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকে ছাড়িয়ে যায় বাংলাদেশ। ওই বছর বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ছিল ১ হাজার ৮৮৮ ডলার। আর ভারতের ছিল ১ হাজার ৮৭৭ ডলার। মূলত কোভিডের কারণে কঠোর লকডাউন, ব্যবসা-বাণিজ্যে শ্লথগতিসহ নানা কারণে ভারতের অর্থনীতি বেশ সংকুচিত হয়। এতেই বাংলাদেশ এগিয়ে যায়। কারণ, কোভিডের মধ্যেও বাংলাদেশের জিডিপি সংকুচিত হয়নি।
দুই দশক ধরে বাংলাদেশ ও ভারতের অর্থনীতি অনেক বেশি দ্রুত হারে এগিয়েছে। দুই দেশের একসঙ্গে এগিয়ে যাওয়ায় ছেদ পড়তে শুরু করে ২০১৭ সাল থেকে। ভারত অর্থনীতির এগিয়ে যাওয়ার গতি ধরে রাখতে পারেনি। অন্যদিকে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি বাড়তেই থাকে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রায় ৮ শতাংশ হয়ে যায়।
আবার গত ১৫ বছরে ভারতের জনসংখ্যা বেড়েছে ২১ শতাংশ, আর বাংলাদেশের বেড়েছে ১৮ শতাংশ। এসবের প্রভাব পড়েছে মাথাপিছু আয়ে। ২০০৭ সালেও বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ছিল ভারতের অর্ধেক। আর ২০০৪ সালে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ছিল বাংলাদেশের তুলনায় ৭০ শতাংশ বেশি।
৮ বছর আগেই পাকিস্তান পেছনে
২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো পাকিস্তানকে মাথাপিছু জিডিপিতে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ। ওই বছর বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৬৫৯ ডলার। পাকিস্তানের ছিল ১ হাজার ৪৬৮ ডলার। এরপর আর কোনো বছর পাকিস্তান বাংলাদেশকে ছাড়াতে পারেনি। মাথাপিছু জিডিপি ওঠানামার মধ্যে ছিল দেশটির। সর্বশেষ ২০২৩ সালে এসে পাকিস্তানের মাথাপিছু জিডিপি দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৭১ ডলার।
ক্রয়ক্ষমতায় পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে, ভারতের চেয়ে পিছিয়ে
একটি দেশের মানুষ কতটা সম্পদশালী, তা বোঝার জন্য তাদের ক্রয়ক্ষমতা কেমন, সেটিকে বিবেচনায় নেওয়া হয়। নিজের আয় দিয়ে একজন মানুষ প্রয়োজনীয় কী কী জিনিস কিনতে পারেন, তা দেখা হয়। বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিকে তুলনা করতে ক্রয়ক্ষমতার সমতা বা পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটির (পিপিপি) ভিত্তিতে জিডিপি এবং মাথাপিছু জিডিপি নির্ধারণ করা হয়। সেই হিসাবে পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। আর ভারতের চেয়ে পিছিয়ে।
২০২৩ সালের আইএমএফের হিসাবে, পিপিপি অনুসারে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ৮ হাজার ৬৭০ ডলার। ভারত ও পাকিস্তানের যথাক্রমে ৯ হাজার ১৮০ ডলার ও ৬ হাজার ৭৭০ ডলার।
Discussion about this post