যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমবাজারে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে কোভিড মহামারির পর। ২০২১ ও ২০২২ সালেও দেশটিতে বিপুলসংখ্যক কর্মী চাকরি ছেড়েছেন বা ছাঁটাই হয়েছেন। এরপর সেই ধারা থামলেও চলতি বছরে আবার কোম্পানির কর্তাদের মধ্যে চাকরি ছাড়ার হিড়িক লেগেছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৭১০ জন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) চাকরি ছেড়েছেন।
সিএনবিসির সংবাদে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে ৪৭ মিলিয়ন বা ৪ কোটি ৭০ লাখ মানুষ চাকরি ছেড়েছেন। এরপর ২০২২ সালে চাকরি ছাড়েন ৫ কোটির বেশি মানুষ। দেশটিতে এভাবে মানুষের গণহারে চাকরি ছাড়ার ঘটনা ‘গ্রেট রেজিগনেশন’ বা ‘গণহারে পদত্যাগ’ হিসেবে খ্যাত। এরপর অবশ্য সেই ধারা থেমে যায়। এ বছরের এপ্রিল মাসে আবার কর্মসংস্থানের পরিমাণ প্রাক্-মহামারি পর্যায়ে ফেরত যায়। এরপরই শুরু হয় সিইওদের চাকরি ছাড়ার হিড়িক।
গত নভেম্বর মাস পর্যন্ত সিইওদের চাকরি ছাড়ার হার গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫১ শতাংশ বেড়েছে। ২০২২ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত চাকরি ছেড়েছিলেন ১ হাজার ১৩৫ জন সিইও। এর আগে ২০১৯ সালে ১২ মাসে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৬৪০ জন সিইও চাকরি ছেড়েছিলেন।
চ্যালেঞ্জার, গ্রে অ্যান্ড ক্রিসমাসের গবেষণায় সিইওদের চাকরি ছাড়ার এই তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু চ্যালেঞ্জার সিএনবিসিকে বলেন, ‘২০২২ সাল থেকে চাকরি ত্যাগের তথ্য সংগ্রহ করছি আমরা; কিন্তু চলতি বছরের প্রথম ১১ মাসে যত সিইও চাকরি ছেড়েছেন, গত ২০ বছরে কখনোই তা হয়নি।’
ছোটখাটো কোম্পানির সিইওরাও চাকরি ছেড়েছেন তা নয়, বরং ইউটিউব, ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম, ওয়ালগ্রিন ও এক্সের (সাবেক টুইটার) মতো বৃহৎ কোম্পানির সিইওরা চাকরি ছেড়েছেন।
মহামারির সময় একধরনের অনিশ্চয়তা ছিল, এখন আরেক রকমের। সিএনবিসির সংবাদে বলা হয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও মন্দার দীর্ঘমেয়াদি শঙ্কার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভাব পড়েছে। এসব কারণে যে শুধু সিইওরা প্রভাবিত হচ্ছেন, তা নয়; সামগ্রিকভাবে কোম্পানির ব্যয় সাশ্রয় থেকে শুরু করে সব স্তরের কর্মীরা সে জন্য প্রভাবিত হতে পারেন।
অ্যান্ড্রু চ্যালেঞ্জার জানান, সিইওরা মহামারি, শ্রমিকসংকট, সরবরাহ ব্যবস্থার সমস্যা, আর্থিক অনিশ্চয়তা ও পরিবর্তনশীল সরকারি নিয়মকানুনের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার পর চাকরি ছাড়ছেন। দেখা যাচ্ছে, অনেক কোম্পানি যখন তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল অবস্থায় আছে, তখন সিইওরা চাকরি ছাড়ছেন। এতে কোম্পানিগুলোর পক্ষে স্বাভাবিকভাবে উত্তরাধিকার পরিকল্পনা করা সম্ভব হচ্ছে। এ ছাড়া অনেক সিইও কাজের ভারে ভারাক্রান্ত; অনেক কোম্পানি আবার প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মুখে নতুন নেতৃত্ব খুঁজছে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো সিইওদের পদত্যাগের কারণ জানায় না। এ বছর এ রকম প্রায় ৫৫০টি ঘটনা দেখা গেছে; অর্থাৎ প্রায় ৩২ শতাংশ সিইওর পদত্যাগের কারণ জানানো হয়নি।
৩৫৭ জন সিইও বা ২১ শতাংশ এ বছর অবসর গ্রহণ করেছেন। ৮৯ জন বা ৫ শতাংশ সিইও নতুন চাকরি পেয়ে আগের চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন।
৫৪ জন সিইও নিজেদের কোম্পানিতে নতুন দায়িত্ব পেয়েছেন; তাঁদের হয়তো অন্য কোনো বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আর ২৯০ জন বা ১৭ শতাংশ সিইও পদত্যাগ করে পরামর্শক বা পরিচালকের ভূমিকায় চলে গেছেন।
বিশ্লেষকেরা অবশ্য সিইওদের গণহারে চাকরি ছাড়ার চারটি কারণ উদ্ঘাটন করেছেন। সেগুলো হলো সিইওদের বিলম্বিত অবসর, অতিরিক্ত শ্রমজনিত ক্লান্তি, সিইওদের নৈপুণ্য কমে যাওয়া ও ভালো সুযোগ।
খাতভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি চাকরি ছেড়েছেন অলাভজনক খাতের সিইওরা। এরপর আছেন স্বাস্থ্যসেবা ও প্রযুক্তি খাতের সিইওরা। অ্যান্ড্রু চ্যালেঞ্জার বলেন, এই দুই খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। মহামারির সময় এই দুই খাতের চাহিদা অনেকটা বেড়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই তখন এসব খাতে বিপুল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন সেই বাস্তবতা নেই, বাস্তবতার সঙ্গে তাল মেলাতে এসব খাতে এখন কর্মী ছাঁটাই হচ্ছে। ব্যবসা খারাপ হওয়ায় সিইওরাও তার বাইরে নন। আবার প্রযুক্তি খাতে এখন এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বিনিয়োগ হচ্ছে। এ খাতে বিপুল অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করতে হচ্ছে। এমনকি গুগলের মতো কোম্পানি এআই গবেষণায় অর্থ বিনিয়োগ ও বেশ কিছু কাজ স্বয়ংক্রিয় করে ফেলার কারণে নতুন করে এখন ৩০ হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনা করছে বলে জানা গেছে।
বাস্তবতা হচ্ছে, একজন কর্মী চাকরি ছেড়ে দিলে সেই খালি জায়গা পূরণ করতে তাঁর বেতনের দেড় থেকে দুই গুণ ব্যয় হয়। কিন্তু সিইওদের প্রতিস্থাপন করতে এর চেয়ে অনেক বেশি ব্যয় হয়। সিইওদের বেতনও অনেক বেশি। ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারের এসঅ্যান্ডপি সূচকভুক্ত কোম্পানিগুলোর সিইওদের গড় বার্ষিক বেতন-ভাতার পরিমাণ ছিল ১৬ দশমিক ৭ মিলিয়ন বা ১ কোটি ৬৭ লাখ ডলার।
বিশ্লেষকেরা বলেন, এটা অনেক বেশি; এরপর যখন তাঁরা চাকরি ছাড়েন, তখন তাঁদের প্রতিস্থাপন করতে অনেক বেশি ব্যয় হয়।
আরেকটি বড় বিষয় হলো, সাধারণ কর্মীদের চাকরি ছেড়ে যাওয়া আর সিইওদের চাকরি ছেড়ে যাওয়া এক বিষয় নয়। সিইওদের চাকরি ছেড়ে যাওয়ার প্রভাব পুরো কোম্পানি ও কর্মীদের ওপর পড়ে। ব্যয়ও বৃদ্ধি পায়। কোম্পানির গতি-প্রকৃতিও কিছুটা বদলে যায়। ফলে সবাইকে কিছু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
এ জেড কে/
Discussion about this post