আপনি কি জানেন, পৃথিবীতে এমন একটি পবিত্র ভূমি রয়েছে যার চারপাশে ফেরেশতারা নিজেদের ডানা মেলে রাখেন? আর সেই ভূমিই হবে কিয়ামতের দিন মানবজাতির সমবেত হওয়ার স্থান। এ ভূমি সম্পর্কে কোরআন ও হাদিসে এমন অনেক বিস্ময়কর কথা বলা হয়েছে, যা জানলে আপনি মুগ্ধ না হয়ে পারবেন না। চলুন, জেনে নেই শামের বরকতপূর্ণ ভূমির আশ্চর্য ইতিহাস।
একদিন আসবে, যখন শাম ভূমি হবে ঈমানদারদের শেষ আশ্রয়স্থল। পৃথিবীজুড়ে ফিতনা ছড়িয়ে পড়লেও এখানকার ভূমি থাকবে নিরাপদ। আল্লাহর ফেরেশতারা এই অঞ্চলে ছায়া দান করবেন। নবী ইসা (আ.) অবতরণ করবেন এই ভূমিতে। আর এখানেই সমাপ্তি ঘটবে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর শত্রু দাজ্জালের।
শুরুতেই এই প্রশ্ন মাথায় আসতে পারে- এমন ভূমির কথা বলা হচ্ছে, সেটি কোনটি? প্রাচীন যুগে যাকে বলা হতো ‘মুলকে শাম’, সেটিই আজকের সিরিয়া, জর্ডান, লেবানন এবং পূর্ণ ফিলিস্তিনের সমন্বিত অঞ্চল। এই ভূমি শুধু ভৌগোলিকভাবে নয়, ইসলামের ইতিহাসে, নবী-রাসুলদের স্মৃতিতে এবং কোরআন-হাদিসে বিশেষভাবে উল্লেখিত। চলুন জেনে নিই, কীভাবে এই বরকতময় ভূমি কিয়ামতের আগে অনন্য ঘটনাবলির কেন্দ্রবিন্দু হবে।
শাম ভূমির বরকতময়তা
কোরআন শরিফে বহু জায়গায় শামের ভূমির বরকত সম্পর্কে আলোচনা এসেছে। আল্লাহতায়ালা বলেন,
যাদের দুর্বল মনে করা হতো, আমি তাদের উত্তরাধিকার দিয়েছি এমন ভূমির, যার পূর্ব ও পশ্চিমে আমি বরকত রেখেছি। (সুরা আরাফ: ১৩৭)
আরেক আয়াতে বলা হয়েছে, ‘পরম পবিত্র তিনি, যিনি তার বান্দাকে মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত রাতের বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন। এর চারপাশে আমি বরকত রেখেছি।’ (সুরা বনি ইসরাঈল: ১) মোফাসসিররা একমত হয়েছেন যে, এই বরকতময় ভূমি বলতে শামকেই বোঝানো হয়েছে।
হাশরের ময়দান হবে শামে
ইমাম কুরতুবি, ইবনে কাসির, এবং ইবনে হাজার (রহ.) বলেছেন, শাম হলো হাশরের ভূমি। প্রথম হাশর সংঘটিত হয়েছে এখানে ইহুদিদের বহিষ্কারের মাধ্যমে। আর দ্বিতীয়বার এই ভূমিতেই সমগ্র মানবজাতি একত্রিত হবে।
রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
তোমাদের হাশর হবে শামের মাটিতে। সেখানেই আরোহী, পদাতিক, ও অধঃমুখী তিন দলে বিভক্ত হবে মানুষ। (মুসনাদে আহমদ: ৩৩/২১৪)
ফেরেশতাদের ছায়া বিছানো থাকে যে ভূমিতে
রসুলুল্লাহ (সা.) শামের প্রশংসা করে বলেছেন, শামের জন্য সৌভাগ্য! কারণ ফেরেশতারা তাদের ডানা দিয়ে এই ভূমিকে আবৃত করে রেখেছে। (তিরমিজি: ৩৯৫৪)
এক বিশেষ হাদিসে বলা হয়েছে,
কিয়ামত পর্যন্ত একটি দল শামে হকের ওপর অটল থাকবে। তাদের কোনো শত্রু কখনো পরাজিত করতে পারবে না। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন যখন শামবাসীরা খারাপ হয়ে যাবে, তখন তোমাদের আর কোনো কল্যাণ থাকবে না। তবে আমার উম্মতের একটি দল সবসময় সাহায্যপ্রাপ্ত হবে। (তিরমিজি: ২১৯২)
শাম হবে নবী ইসা (আ.)-এর অবতরণের স্থান
হজরত ইসা (আ.) কিয়ামতের আগে সিরিয়ার দামেস্ক নগরীর পূর্বদিকে অবতরণ করবেন। সেখানেই তিনি দাজ্জালকে হত্যা করবেন। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, দাজ্জাল ইসা (আ.)-কে দেখামাত্র গলে যাবে। তারপর তিনি নিজের হাতে তাকে হত্যা করবেন। (মুসলিম: ৭১৭০)
ফিতনা থেকে নিরাপদ ভূমি সিরিয়া বা শাম
যখন পৃথিবীতে ফিতনা ছড়িয়ে পড়বে, তখন শাম থাকবে শান্ত ও নিরাপদ। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ফিতনার সময়ে শাম হবে ঈমানের ঘাঁটি। কোরআনের আলো এখান থেকেই ছড়াবে। (মুসতাদরাকে হাকিম: ৫/৭১২)
নবী কারিম (সা.) তার উম্মতকে শামে অবস্থানের জন্য অসিয়ত করেছেন। তিনি বলেছেন “যখন ফিতনা ছড়িয়ে পড়বে, তখন শামের ভূমি আঁকড়ে ধরো।” (মুসনাদে আহমদ: ৯/১৪৫)
শুরাইহ ইবনে উবাইদ (রহ.) বলেন, হজরত আলী (রা.) একবার শামবাসীদের প্রতি অভিশাপ দেয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেন,
আমি রসুলুল্লাহ (স.)-কে বলতে শুনেছি, শামে আবদালরা (আল্লাহর বিশেষ ওলি) অবস্থান করেন। তারা ৪০ জন থাকেন। যখন একজন মারা যান, আল্লাহ তার স্থানে আরেকজনকে নিযুক্ত করেন। তাদের বরকতে বৃষ্টি হয় এবং শত্রুর বিরুদ্ধে জয়লাভ হয়। (মুসনাদে আহমদ ৮৯৬)
মুয়াবিয়া ইবনে কুররা (রা.) বর্ণনা করেন, রসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, যখন শাম ফাসাদে জড়িয়ে পড়বে, তখন তোমাদের মধ্যেও কোনো কল্যাণ থাকবে না। আমার উম্মতের একটি দল সর্বদা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে আর কিয়ামত পর্যন্ত কেউ তাদের ক্ষতি করতে পারবে না। (তিরমিজি ২১৯২)
হজরত আবুদ্দারদা (রা.) বর্ণনা করেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, মহাযুদ্ধের সময় মুসলিমদের ছাউনি হবে গোতা শহরে, যা দামেস্কের পাশে অবস্থিত। এটি শামের একটি উৎকৃষ্ট স্থান। (আবু দাউদ ৪২৯৮)
মুমিনদের শেষ আশ্রয়স্থল হলে শামে
রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
মুমিনদের বাসভূমি হবে শামের পবিত্র ভূমি। (মুসনাদে আহমদ: ২৮/১৬৫) শামের ভূখণ্ড শুধুই একটি ভূমি নয়; এটি বরকতময় এবং আল্লাহতায়ালার বিশেষ রহমতের প্রতীক। কিয়ামতের আগে এই অঞ্চলে সংঘটিত হবে এমন অনেক ঘটনা, যা পৃথিবীর ইতিহাসে অনন্য হয়ে থাকবে। এই ভূমি শুধু নবী-রসুলদের স্মৃতি নয়, বরং এক মহা বরকতময় ভবিষ্যতের ইঙ্গিতও বহন করে। তাই, এই ভূমির ফজিলত আমাদের জন্য এক বিশেষ বার্তা।
ইমাম মাহদির খেলাফত ও ভূমিধস
উম্মে সালামা (রা.) বর্ণনা করেন, রসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, একজন খলিফার মৃত্যুর পর মতানৈক্য দেখা দেবে। তখন একজন ব্যক্তি (ইমাম মাহদি) মদিনা থেকে মক্কায় আসবেন আর মানুষের চাপের মুখে বাইয়াত গ্রহণ করবেন। তার বিরুদ্ধে শাম থেকে একটি দল পাঠানো হবে, কিন্তু তারা বাইদা নামক স্থানে ভূমিধসে পতিত হবে। (মুসলিম ২৮৮২)
শামের ভূমি ইসলামের ইতিহাসে এবং ভবিষ্যদ্বাণীগুলোর আলোকে এক মহাবরকতময় স্থান হিসেবে উল্লেখিত। এটি শুধু নবী-রসুলদের স্মৃতিধন্য নয়, বরং কিয়ামতের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলির কেন্দ্রবিন্দু। হাশরের ময়দান থেকে শুরু করে নবী ইসা (আ.)-এর আগমন, দাজ্জালের পরাজয় এবং ফিতনা থেকে নিরাপত্তার বাণী- সবকিছুই শামের বিশেষ মর্যাদার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
বর্তমান সময়ে শামের পরিস্থিতি বিবেচনা করলে দেখা যায়, এই ভূমিতে সংঘটিত ঘটনাগুলো ইসলামের ভবিষ্যদ্বাণীগুলোর প্রাসঙ্গিকতাকে তুলে ধরছে। শামের ভূমি শুধু ভৌগোলিক অঞ্চল নয়, বরং তা ঈমানদারদের জন্য শিক্ষা, সতর্কতা এবং আশা জাগ্রত করার এক অনন্য প্রতীক। আমাদের উচিত শামের ভূমি সম্পর্কে আরও জানার চেষ্টা করা, নবীজি (সা.)-এর অসিয়ত অনুসরণ করা এবং এই বরকতময় ভূমির ফজিলত হৃদয়ে ধারণ করা।
আল্লাহ আমাদেরকে কিয়ামতের আগেই নিজেদের পরিশুদ্ধির তাওফিক দান করুন। কিয়ামতের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করুন। আমিন।
এম এইচ/
Discussion about this post