নতুন অবকাঠামো ভাগাভাগির নীতিমালাকে (ইনফ্রাস্ট্রাকচার শেয়ারিং গাইডলাইন) কেন্দ্র করে দেশের টেলিযোগাযোগ খাতে বড় ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। হঠাৎ করে নতুন এই নীতিমালা প্রণয়ণের মধ্য দিয়ে ২০০৮ সালের আগের মতই টেলিযোগাযোগ খাতে একটিমাত্র মোবাইল অপারেটরের আধিপত্য নিশ্চিত করবে। অন্যদিকে দেশীয় বিনিয়োগে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অস্তিত্ব সংকটে ফেলবে। সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়বে দেশীয় উদ্যেক্তাদের বিনিয়োগে পরিচালিত ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবাদাতা (আইএসপি) প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে দেশে দাম বাড়বে ইন্টারনেট সেবার, এমনকি নিরবচ্ছিণ্ন মোবাইল নেটওযার্ক সেবাও বিঘ্নিত হতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবার চাহিদা বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনায় রেখে মোবাইল অপারেটরদের হাতে দেশের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবসা তুলে দেয়ার আয়োজন থেকেই কোন প্রয়োজন ছাড়াই ২০০১ সালের টেলিযোগাযোগ আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে তড়িঘড়ি করে ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার শেয়ারিং গাইডলাইন’ অনুমোদন করতে যাচ্ছে বিটিআরসি। আগামী ২৯ ডিসেম্বর কমিশন সভায় এরই মধ্যে ব্যাপক মাত্রায় বিতর্কিত হয়ে পড়া ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার শেয়ারিং গাইডলাইন’ অনুমোদন করার আয়োজন চূড়ান্ত করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০০১ সালের টেলিযোগাযোগ আইনের আলোকে এর আগে একটি এনটিটিএন নীতিমালা করা হয়েছে। সংশোধনের প্রস্তাব গত প্রায় দুই বছর ঝুলিয়ে রেখে নতুন ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার শেয়ারিং গাইডলাইন’ করার বিষয়টি বড় ধরনের প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। বিটিআরসির এই বিতর্কিত উদ্যোগ টেলিযোগাযোগ খাতে বড় ধরনের অস্থিরতা তৈরি করবে। বরং বিদম্যান এনটিটিএন গাইডলাইন সংশোধনের জন্য আরও দুই বছর আগে দেয়া প্রস্তাব অনুমোদিত হলে টেলিযাগাযোগ খাতে দেশীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ উভয় ধরনের কোম্পানির জন্য ব্যবসার সমান সুযোগ সৃষ্টি হত।
এর আগে বিটিআরসি হঠাৎ করেই একটি ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার শেয়ারিং গাইডলাইন’ করার কথা জানিয়ে গত ১৮ ডিসেম্বর এই গাইডলাইনের খসড়া ওয়েবসাইটে দেয়। খসড়া অনুযায়ী মোবাইল অপারেটরদের নিজস্ব ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক নির্মাণের অনুমতি দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া এর মাধ্যমে মোবাইল অপারেটরদের ফিক্সড ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা দেয়ারও সুযোগ সৃষ্টি হবে। ফলে এই নীতিমালা অনুমোদন হলে টেলিযোগাযোগ খাতের সব ধরনের সেবার নিয়ন্ত্রণ শুধুমাত্র তিনটি মোবাইল অপারেটরের কাছে চলে যাবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই নীতিমালার মাধ্যমে মূলত তিনটিও নয়, ২০০৮ সালের পূর্র মত একটিমাত্র মোবাইল অপারেটরের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন টেলিযোগাযোগ খাত বিশেষজ্ঞ বলেন, ২০০৮ সালের আগে দেশের টেলিযোগাযোগ খাতে একটি মোবাইল অপারেটরের একক আধিপত্য ছিল। মূলত এই মোবাইল অপারেটরের কাছে আরও তিনটি মোবাইল অপারেটর এবং ইন্টারেনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো জিম্মি হয়ে পড়েছিল। কারণ সে সময় ট্রান্সমিশন এবং ব্যান্ডউইথের পাইকাড়ি সরবরাহ এই মোবাইল অপারেটরের নিয়ন্ত্রণে ছিল। সে সময় ট্রান্সমিশন সেবার জন্য অপর দু’টি মোবাইল অপারেটরকে প্রতি সার্কিট ট্রান্সমিশন সেবার জন্য গ্রামীণফোনকে ১৫ লাখ থেকে ২০ লাখ পরিশোধ করতে হত। আর প্রতি এমবিপিএস ব্যান্ডউইথ পরিবহনের জন্য ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হত। এছাড়া ভয়েস কলের জন্য আন্তঃসংযোগের ক্ষেত্রে অন্য তিনটি মোবাইল অপারেটরের জন্য মাত্র একশ’টি শেয়ারিং সার্কিট খোলা রাখত প্রভাবশালী মোবাইল অপারেটরটি। ফলে সাধারণ অন্য তিনটি অপারেটরদের গ্রাহকরা প্রচণ্ড দুর্ভোগ পোহাতেন।
এই বিশেষজ্ঞ জানান, সে সময় বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও টেলিযোগাযোগ খাত জিম্মি করে রাখা প্রভাবশালী মোবাইল অপারেটর ট্রান্সমিশন সেবা এবং ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের দাম কমায়নি। ফলে সারা দেশে ফাইবার অপটিক সেবাও সম্প্রসারণ করাও সম্ভব হচ্ছিল না। ফলে দেশে ডিজিটাল ডিভাইড বাড়ছিল। এ কারণেই ২০০৮ সালে তত্ত্ববধায়ক সরকারের আমলে ২০০১ সালের টেলিযোগাযোগ আইন অনুযায়ী নীতিমালার মাধ্যমে টেলিযোগাযোগ খাতে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করে এমন একটি কমন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরে এ লক্ষ্যে একটি এনটিটিএন নীতিমালা তৈরি করা হয়।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এনটিটিএন লাইসেন্সের জন্য একটিমাত্র প্রতিষ্ঠান ফাইবার অ্যাট হোম আবেদন করে। কারন সে সময় এ ব্যবসার জন্য বিনিয়োগের ঝুঁকি অন্য কোন প্রতিষ্ঠান নিতে চায়নি। ফলে দেশের প্রথম বেসরকারি এনটিটিএন অপারেটর হিসেবে ফাইবার অ্যাট হোম লাইসেন্স পায়। এই প্রতিষ্ঠান যাত্রা শুরু পর মোবাইল অপারেটরদের জন্য সার্কিট প্রতি ট্রান্সমিশন সেবার মূল্য ১৫ লাখ টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকায়ে নেমে আসে। ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ পরিবহন খরচ প্রতি এমবিপিএস ১০ হাজার টাকা থেকে ৩০০ টাকায় নেমে আসে। পরে ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দ্বিতীয় বেসরকারি এনটিটিএন অপারেটর হিসেবে লাইসেন্স পায় সামিট কমিউনিকেশন। এই লাইসেন্স পাওয়াসহ পরবর্বতী সময়ে সাবমেরিন কেবল কোম্পানি ও টাওয়ার সেবার লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ রয়েছে সামিটের বিরুদ্ধে।
টেলিযোগাযোগ খাত বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, তড়িঘড়ি করে নতুন এই ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার শেয়ারিং গাইডলাইন’ তৈরির উদ্যেগ অহেতুক। এটি অনুমোদন পেলে টেলিযোগাযোগ খাতে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে এবং অস্থিরতার সৃষ্টি করবে। কারণ এর ফলে গত দেড় দশক ধরে টেলিযোগাযোগ ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক তৈরি করা দেশীয় এনটিটিএন কোম্পানি অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।
তিনি বলেন, এর পাশাপাশি মোবাইল অপারেটরদের ক্ষেত্রে আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলোর ফিক্সড ব্রডব্যান্ড ব্যবসারও দখল নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। ফলে দেশে আবারও ২০০৮ সালের আগের মত ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের দাম বাড়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
তিনি বলেন, বিদ্যমান এনটিটিএন গাইডলাইনের দু’একটি বিষয় মোবাইল অপারেটরদের কিছু পর্যবেক্ষণ এবং বিতর্ক ছিল। এ কারণে ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে বিটিআরসিতে বিদ্যমান এনটিটিএন নীতিমালা সংশোধনের একটি প্রস্তাব দেয়া হয়। এ প্রস্তাবের আলোকে বিটিআরসি একটি কমিটি গঠন করে। পরে ওই কমিটি তিনবার পরিবর্তণ করা হয়। অথচ ওই নীতিমালা সংশোধন করা হলে এখন এ ধরনের বিতর্কিত ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার শেয়ারিং গাইডলাইন’ তৈরির প্রয়োজন হত না।
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের প্রসিকিউটর ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ল এর খন্ডকালিন শিক্ষক সাইমুম রেজা তালুকদার বলেন, দেখা যাচ্ছে খসড়া ইনফ্রাকস্ট্রাকচার শেয়ারিং গাইডলাইনের যে উদ্দেশ্য এবং প্রয়োজনের কথা বলা হয়েছে তা বিদ্যমান এনটিটিএন নীতিমালার সঙ্গে হুবহু এক। এর অর্থ এনটিটিএন নীতিমালা সংশোধনই যথেষ্ট ছিল। সেটা না করে একই ধরনের নতুন একটি গাইডলাইন প্রণয়নের উদ্যেগ কি কারণে হচ্ছে তা বোধগম্য নয়।
এন পি/
Discussion about this post