বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে রাজনীতিকদের মধ্যে উদ্বেগ ও আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনা তৈরি হয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গণতন্ত্র পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বিতর্কিত সন্ত্রাসবিরোধী আইন সংশোধনের মাধ্যমে জারি করা নিষেধাজ্ঞা আইনি ও নৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। এটি সেই পুরোনো রাজনৈতিক প্রতিশোধের চক্রকে আবার জাগিয়ে তুলতে পারে। এখনও ব্যাপক জনসমর্থন থাকায় বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের উচিত, আওয়ামী লীগের ওপর থেকে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করে তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া। বৃহস্পতিবার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য ইকোনমিস্ট-এ প্রকাশিত একটি নিবেন্ধ এসব কথা বলা হয়েছে।
ইকোনমিস্টের প্রিন্ট সংস্করণের লিডার্স শাখায় ‘আনব্যান দ্য আওয়ামী লীগ’ শিরোনামে প্রকাশিত লেখাটি অনলাইন ভার্সনে ‘ব্যানিং দ্য অপজিশন ইজ নো ওয়ে টু রিভাইভ বাংলাদেশ’স ডেমোক্র্যাসি’ শিরোনামে প্রকাশ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার চার বছরের মধ্যেই দেশটি সামরিক অভ্যুত্থানের চক্রে পড়ে পথ হারিয়ে ফেলে। একই ধারা আবার দেখা যাচ্ছে গত বছর আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত কথিত ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’র ক্ষেত্রেও।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়ে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ক্ষমতা গ্রহণ করে অন্তবর্তীকালীন সরকার।
তবে বছর ঘুরতে না ঘুরতে, কথিত নতুন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আবারও শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ড. ইউনূসের সরকারের হাতে খুবই কঠিন একটা কাজ তুলে দেওয়া হয়েছিল বলে ইকোনমিস্টের নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে। দীর্ঘদিনের অপশাসনে দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে পড়া, দুর্নীতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে যাওয়া এবং সরকারবিরোধীদের আইন বহির্ভূতভাবে মারধর করার ঘটনা ছিল সাবেক সরকারের আমলের প্রায় নিয়মিত ঘটনা।
অর্থনীতি কিছুদিন অসাধারণ অগ্রগতি দেখালেও তা একসময় তাল হারিয়ে ফেলে। পরিস্থিতি এতটাই নাজুক হয়ে পড়ে যে, দেশের এক-পঞ্চমাংশ তরুণ বেকার হয়ে পড়ে।
এই প্রেক্ষাপটে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার কিছু অগ্রগতি অর্জন করেছে। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের ইঙ্গিত দিয়েছেন তারা। মন্দার মধ্যে অর্থনীতি স্থিতিশীল রেখে মূল্যস্ফীতি হ্রাস পেয়েছে এবং আন্তর্জাতিক ঋণদাতারা নতুন করে ঋণ দিতে শুরু করেছে।
তবে পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলাদেশ চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এর মাধ্যমে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও অস্ত্র কেনার ক্ষেত্রে এটি সুবিধাজনক বলে মনে করছে বর্তমান সরকার। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঝুঁকিতে পড়েছে। অন্যদিকে, পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতায় ভারত অসন্তুষ্ট হয়েছে। গত বছর পর্যন্ত যেটি ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, এখন সেখানে উত্তেজনা বাড়ছে। ফলস্বরূপ, ভারত একটি ট্রানজিট চুক্তি বাতিল করেছে, বাংলাদেশি অভিবাসীদের ফেরত পাঠিয়েছে এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ পানি বণ্টন চুক্তি পুনরায় আলোচনার দাবি জানিয়েছে।
ড. ইউনূসের গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে নতুন নির্বাচনের পদ্ধতিতে সম্মত করিয়ে দেশের রাজনীতি নতুন করে গড়ে তোলা। তবে এর প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এই রাজনৈতিক মনোমালিন্যের রেশ গড়াচ্ছে হাঙ্গামাতে।
জুনের মাঝামাঝি একদল লোক এক সাবেক নির্বাচন কমিশনারকে হেনস্তা করে যার বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের ভোট কারচুপিতে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
এর আগে মে মাসে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে অন্তবর্তীকালীন সরকার। এতে দেশে-বিদেশে সৃষ্টি হয় ব্যাপক বিতর্ক। দুর্নীতির দায়ে দলটির শীর্ষ নেতাদের বিচারের আওতায় আনা যৌক্তিক হলেও, মনে করা হচ্ছিলো দলটির সাধারণ সদস্যরা নিজেদের পুনর্গঠনের সুযোগ পাবে। এই নিষেধাজ্ঞা একটি বিতর্কিত সন্ত্রাসবিরোধী আইন সংশোধনের মাধ্যমে চালু করা হয়েছে, যা আইনি ও নৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। এটি সেই পুরোনো রাজনৈতিক প্রতিশোধের চক্রকে আবার জাগিয়ে তুলতে পারে।
বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের উচিত, আওয়ামী লীগের ওপর থেকে বিধিনিষেধ সরিয়ে তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া। তাদের এখনও ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে।
তাদের স্বাধীনভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে দিলেও আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়লাভ করবে, সে সম্ভাবনা কম। তবে সংসদে তাদের উপস্থিতিতে বিজয়ীরা জবাবদিহির মধ্যে থাকবে। নতুন বাংলাদেশ তৈরিতে প্রতিহিংসার বদলে পুনর্মিলন প্রয়োজন।
এম এইচ/
Discussion about this post