আল্লাহতায়ালা আমাদের সবচেয়ে বড় কল্যাণকামী। আমাদের মঙ্গল চান। সৎকাজের সুযোগ দিয়ে আমাদের মর্যাদাবান করতে চান। এ কারণে বছরজুড়ে নিয়মিত আমলের পাশাপাশি বান্দার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিশেষ বিশেষ ফজিলতপূর্ণ মাস ও দিবস দান করেছেন তিনি। বান্দা যেন সেই দিবসগুলোতে ইবাদত করে আমলের খাতা সমৃদ্ধ করতে পারে। মহররম, আশুরা, রমাদান, লাইলাতুল কদর, মধ্য শাবানের রজনী, আরাফাহ এই ধরনের ফজিলতপূর্ণ মাস ও দিবসের উদাহরণ।
ব্যবসায়ীরা সারাবছরই পণ্য বিক্রি করেন। তবু বিশেষ বিশেষ দিবস উপলক্ষে তারা পণ্যের ওপর ডিসকাউন্ট, ক্যাশব্যাক, বাই ওয়ান, গেট ওয়ান অফার দিয়ে থাকের। ক্রেতারা যেন খুশি হন এবং নির্দিষ্ট ওই দোকান থেকেই নিয়মিত কেনাকাটা করেন। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, আমরা পণ্যের অফারের জন্য সারাবছর অপেক্ষা করি। কিন্তু আল্লাহর দেয়া সাওয়াবের অফার পেতে আমাদের তেমন কোনো আগ্রহ নেই।
আজ আমরা আল্লাহর পক্ষ থেকে পাওয়া ইবাদতের বিশেষ অফার মধ্য শাবানের রজনী সম্পর্কে আলোচনা করব। স্থানীয় ভাষায় যাকে আমরা শবে বরাত বলে থাকি। এই রাত সম্পর্কে আমাদের সমাজে অনেক বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি পরিলক্ষিত হয়। একদল রাতটির অস্তিত্বই অস্বীকার করে বসেন। আরেক দল এই রাতে ইবাদতের ক্ষেত্রে অনেক অতিরঞ্জন করে থাকেন। কোন দল সঠিক? শবে বরাত বা মধ্য শাবানের রজনী বলতে আসলেই কি কিছু আছে ইসলামে? এই রাতে ইবাদতের প্রামাণ্য কোনো বর্ণনা কি পাওয়া যায়? আসুন, পর্যালোচনা করি।
মধ্য শাবানের রজনীর প্রামাণ্যতা
মধ্য শাবানের রজনীতে সালাত সিয়াম এবং অফুরন্ত ফজিলতের ব্যাপারে তেমন কোনো বিশুদ্ধ হাদীস পাওয়া যায় না। এই রাতের সালাত, সিয়াম ও কবর জিয়ারতের ব্যাপারে যত হাদীস বর্ণিত হয়েছে, সনদের দিক থেকে সবই দুর্বল, কোনোটা জাল। তবে একটি রাতের ফজিলতের ব্যাপারে যখন অনেক হাদীস পাওয়া যায়, হোক সেগুলো দুর্বল, সমষ্টিগতভাবে রাতটির মৌলিক ফজিলত প্রমাণিত হয়ে যায়।
তাছাড়া ইবাদত-বন্দেগি না থাকলেও রাতটি যে বিশেষ রহমতপূর্ণ, সে ব্যাপারে হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এটাই মধ্য শাবানের রজনীর একমাত্র সহীহ হাদীস। হাদীসটি হলো- আল্লাহতায়ালা মধ্য শাবানের রাতে সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন। ইবনে মাজাহ ১৩৯০
বিভিন্ন সনদে আটজন সাহাবী হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। এ হাদীস থেকে প্রতীয়মান হলো, শাবান মাসের ১৫ তারিখ রাতের বিশেষ একটি অবস্থান ইসলামে আছে। অর্থাৎ, এই রাতে বিশেষ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ বান্দাদের প্রতি আল্লাহ রহমতের দৃষ্টিতে তাকান এবং সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। যে রাতের ব্যাপারে সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা প্রমাণিত হয়, সেই রাতটি অবশ্যই ফজিলতপূর্ণ।
দুটি গুনাহ ত্যাগ করলেই সাধারণ ক্ষমা
আল্লাহ বান্দার প্রতি এতটাই ক্ষমাশীল, মধ্য শাবানের রাতে মাত্র দুটি গুনাহ ত্যাগ করলেই তিনি সাধারণ ক্ষমার অন্তর্ভুক্ত হবেন। অর্থাৎ, এই রাতে কেউ যদি নফল ইবাদত-বন্দেগি নাও করেন, শুধু শিরক এবং হিংসামুক্ত থাকলেই তিনি ক্ষমার উপযুক্ত হয়ে উঠবেন। যদিও ক্ষমার রজনীতে দোয়া ও বন্দেগিতে মশগুল থাকা মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতির অংশ। তারপরও কেউ যদি বন্দেগিতে মশগুলো নাও হয়, তবু সে দুটি গুনাহ না করার শর্তে ক্ষমাপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবেন, ইনশাআল্লাহ।
শিরকের ভয়াবহতা
শিরক পৃথিবীর ভয়ংকরতম পাপের একটি। শিরকের মাধ্যমে মহামহিম আল্লাহর অংশীদার সাব্যস্ত করা হয়, যা আল্লাহর পবিত্র সত্তার জন্য চরম অবমাননাকর। পবিত্র কুরআনে শিরকের ভয়াবহতা এবং শাস্তি সম্পর্কে অনেক আয়াত নাযিল হয়েছে। সেই আয়াতগুলোও শিরকের ভয়াবহতার সাক্ষ্য দেয়। যেমন সুরা মায়েদায় ইরশাদ হচ্ছে : নিশ্চয় যে আল্লাহর সাথে শরীক করে, তার উপর অবশ্যই আল্লাহ জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন এবং তার ঠিকানা আগুন। আর জালিমদের কোনো সাহায্যকারী নেই। সুরা মায়েদা ৭২
আল্লাহতায়ালা আরো বলেছেন : নিশ্চয় আল্লাহ তার সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করেন না। তিনি ক্ষমা করেন এ ছাড়া অন্যান্য পাপ, যাকে তিনি চান। আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সে অবশ্যই মহাপাপ রচনা করে। সুরা নিসা ৪৮ শিরক মহাপাপ হওয়ার কারণেই মধ্য শাবানের রাতে শিরককারী সাধারণ ক্ষমার অন্তর্ভুক্ত হবে না।
হিংসার ভয়াবহতা
ক্বলবের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি পাপ হলো হিংসা। পৃথিবীতে খুব কম মানুষই আছেন, যিনি আত্মার এই ব্যাধি থেকে মুক্ত। অনেকে হৃদয়ে হিংসার আগুন পুষে বেড়ান অথচ বুঝতেও পারেন না তিনি হিংসা-রোগে আক্রান্ত। আপনার মধ্যে হিংসা আছে কি না, বুঝতে হলে হিংসার পরিচয় জানতে হবে।
অপরের উন্নতি যদি আপনার আত্মপীড়নের কারণ হয় এবং আপনি যদি সেই উন্নতির ধ্বংস কামনা করেন, বুঝে নিতে হবে আপনি হিংসায় আক্রান্ত। সেই উন্নতি যে কোনো ধরনের হতে পারে। একজন আর্থিকভাবে সচ্ছল, একজনের চেহারা ভালো, একজন পড়াশোনায় আপনার থেকে এগিয়ে, একজনের সন্তান মেধাবী-আপনি এগুলোর কোনোটিই মানতে পারছেন না।
এদের কথা ভাবলেই আপনার মন বিষণ্ন হয়ে যায়। এদের সাফল্য আপনার বুকের ভেতর ধিকধিক করে আগুন জ্বালায়, আপনি রাতদিন তাদের উন্নতির পতন কামনা করেন-আপনি হিংসা ব্যাধিতে আক্রান্ত। যারা হিংসা করে তারা মূলত আল্লাহর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে। এটা অনেক বড় গর্হিত অপরাধ। হিংসার কারণেই শত ইবাদত করার পরও ইবলিস পরিণত হয়েছে শয়তানে।
হিংসার ব্যাপারে রাসুল সা. বলেছেন : তোমরা হিংসা হতে বেঁচে থাকো। কেননা হিংসা সৎকর্মসমূহকে খেয়ে ফেলে, যেভাবে কাষ্ঠখণ্ডকে আগুন খায়। (আবু দাউদ ৪৯০৩, আলবানী যইফ, শুআইব আরনাউত হাসান লি গাইরিহী।)
অন্যান্য গুনাহের সঙ্গে হিংসার একটি পার্থক্য আছে। অন্যান্য গুনাহ দৃশ্যমান, হিংসা বায়বীয়। অন্যান্য গুনাহ দেখা যায়, হিংসা দেখা যায় না। এ কারণে অন্যান্য গুনাহ করার আগে লোকলজ্জার ভয়ে হলেও একজন দীনদার মানুষ দশবার ভাবে, কিন্তু হিংসা করার আগে একবারও ভাবে না। অনেক দীনদার তো এটাকে কোনো গুনাহই মনে করে না। এই জন্য আমি বলি, হিংসা এদেশের দীনদার মানুষের প্রিয় গুনাহ। হিংসা ভয়ংকর পাপ বলেই শবে বরাত বা মধ্য শাবানের রাতে হিংসুকরা সাধারণ ক্ষমা থেকে বঞ্চিত হবে। এ রাতে ক্ষমা পেতে হলে হৃদয় থেকে অবশ্যই হিংসা দূর করতে হবে।
একটি ভুল ধারণার অপনোদন
অনেকের ধারণা, শবে বরাত বা মধ্য শাবানের রাতে ভাগ্য লেখা হয় বা ভাগ্যের পুনর্মূল্যায়ন করা হয়। ধারণাটি সঠিক নয়। সুরা দুখানের দুই এবং তিন নম্বর আয়াত থেকে এই ভুল ধারণা তৈরি হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেছেন : নিশ্চয় আমি এটি নাযিল করেছি বরকতময় রাতে; নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। সে রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়। দুখান ৩-৪
অনেকে আয়াতে বর্ণিত রাতটিকে মধ্য শাবানের রাত হিসেবে গ্রহণ করে বলেছেন, মধ্য শাবানের রাতে সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধান্ত হয়। এই ব্যাখ্যা সঠিক নয়। তার কারণ, আয়াতের প্রথমাংশে কুরআন নাযিলের কথা বলা হয়েছে। আর এটা সর্বজনস্বীকৃত বিষয় যে, আল্লাহ শাবান মাসে কুরআন নাযিল করেননি। তিনি কুরআন নাযিল করেছেন লাইলাতুল ক্বদরে। ফলে সুরা দুখানে বর্ণিত রাত ক্বদরের রাত, মধ্য শাবানের রাত নয়।
শাবান মাসের বিশেষ ইবাদত
মধ্য শাবানের রজনী বা শবে বরাত যেহেতু শাবান মাসের বিশেষ একটি রাত, একারণে আলোচনার শেষ পর্যায়ে শাবান মাসের সামগ্রিক একটি আমলের কথা আপনাদের বলতে চাই। আপনারা জানেন, রাসুল সা. আমাদের মতো ফরয আমল করাকেই যথেষ্ট মনে করতেন না, বরং ফরযের পাশাপাশি অনেক নফল ইবাদত তিনি করতেন। ফরয সালাতের পাশাপাশি অনেক নফল সালাত তিনি পড়তেন। ফরয সিয়ামের পাশাপাশি অনেক নফল সিয়াম তিনি রাখতেন।
আর শাবান মাস ছিল রাসুল সা. এর নফল রোযা রাখার প্রিয় মাস। প্রায় পুরো মাস জুড়ে তিনি নফল সিয়াম পালন করতেন। এ মাসে তিনি এতবেশি নফল সিয়াম পালন করতেন, আম্মাজান আয়েশা রা. বলেছেন, রাসুল সা.-কে শাবান মাসের চেয়ে অন্য কোনো মাসে অধিক নফল সিয়াম পালন করতে দেখিনি। কেন রাসুল সা. শাবান মাসে এতবেশি রোযা রাখেন- এ বিষয়ে রাসুল সা.-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল। প্রত্যুত্তরে তিনি বলেন :
শাবান মাস রজব এবং রমযানের মধ্যবর্তী এমন একটি মাস, যে মাস সম্পর্কে মানুষ উদাসীন থাকে। আর এটা এমন মাস, যে মাসে আমলনামা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকটে উত্তোলন করা হয়। তাই আমি পছন্দ করি যে, আমার আমলনামা আল্লাহর নিকটে উত্তোলন করা হবে আমার সাওম পালনরত অবস্থায়।
আমরা অধিকাংশ মানুষ রোযা রাখার জন্য শবে বরাতকে বেছে নিই, শবে বরাতের জন্য সারা বছর অপেক্ষা করি। অথচ হাদীসে রোযা রাখার জন্য সুনির্দিষ্টভাবে এই রাতটিকে নির্বাচন করা হয়নি। বরং প্রকৃত সুন্নাহ হলো, পুরো মাস জুড়ে আপনাকে কমবেশি রোযা রাখতে হবে, যেভাবে রোযা রেখেছেন আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আর শবে বরাত বা মধ্য শাবানের রাতের রহমত পেতে হলে আপনাকে শিরক ও হিংসা বর্জন করতে হবে। এ রাতের ফরয দায়িত্ব পালনের পর শিরক ও হিংসা বর্জন করে আপনি যদি সারারাত ঘুমিয়েও কাটান, আল্লাহ আপনার দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন।
আল্লাহ আমাদেরকে শিরক, হিংসাসহ সকল পাপ থেকে মুক্ত থাকার এবং শাবান মাসে অধিক পরিমাণে রোযা রাখার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : শায়খ আহমাদুল্লাহ, ইসলামি ব্যক্তিত্ব ও আলোচক
সূত্র – চ্যানেল টোয়েন্টিফোর
এ এস/
Discussion about this post