বিদেশে অভিবাসী কর্মীদের একটি পছন্দের গন্তব্য ছিল উপসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র বাহরাইন। কাজের উদ্দেশ্যে ২০১৬ সালে বাহরাইনে পাড়ি জমান ৭২ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশী। ২০২০ সালে এ সংখ্যা মাত্র ৩-এ নেমে আসে। আর চলতি বছর এ পর্যন্ত গেছেন মাত্র একজন। আগে বাংলাদেশ থেকে বাহরাইনে মাঝারি আকারের জনশক্তি রফতানি হলেও ২০২০ সাল থেকে তা একেবারে তলানিতে নেমে আসে। গত চার বছরে বাংলাদেশ থেকে দেশটিতে গেছেন মাত্র ২৫ জন। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে রেমিট্যান্স ও কর্মসংস্থানে।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) কর্মকর্তারা জানান, দেশটির চাহিদাপত্র না থাকায় সেখানে জনশক্তি রফতানি করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে বাহরাইনের ইনফরমেশন অ্যান্ড ই-গভর্নমেন্ট অথরিটির তথ্য বলছে, ২০২০ সালের পর থেকে দেশটিতে অভিবাসী কর্মীর সংখ্যা বাড়ছে।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বাহরাইনে সর্বোচ্চ শ্রমশক্তি রফতানি হয় ২০১৬ সালে। ওই বছর দেশটিতে ৭২ হাজার ১৬৭ জনকে পাঠানো হয়। পরের বছর ১৯ হাজার ৩১৮ জন শ্রমিক দেশটিতে যায়। ২০১৮ সালে ৮১১ জন, ২০১৯ সালে ১৩৩, ২০২০ সালে তিন, ২০২১ সালে ১১ ও ২০২২ সালে ১০ জন কাজের উদ্দেশ্যে দেশটিতে পাড়ি জমান। চলতি বছর তা কমে মাত্র একজনে দাঁড়ায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘আপাতত বাহরাইনে শ্রমশক্তির চাহিদা নেই। বর্তমানে অবকাঠামো উন্নয়নেরও বড় কোনো প্রজেক্ট নেই। মাঝখানে তারা জনশক্তি আমদানি কিছুদিন বন্ধ রেখেছিল। এখন খুলে দিলেও সে রকম কোনো চাহিদা নেই। তাছাড়া বাহরাইনকে আমরা ইন্টারেস্টিং মার্কেট হিসেবে দেখি না। সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো বাজারে যে রকম বড় বড় প্রজেক্ট আছে, উন্নয়ন কার্যক্রম চলছে, সে রকম পরিস্থিতি দেশটিতে নেই।’
২০১৮ সালের ৫ আগস্ট বাহরাইনের মোহাররক এলাকায় সিদা মসজিদের বাংলাদেশী মুয়াজ্জিন কামাল উদ্দিনের হাতে খুন হন স্থানীয় ইমাম আবদুল জলিল হামদ। মসজিদের ভেতরে তাকে হত্যার পর মরদেহ তিন টুকরো করে বস্তায় ভরে দূরে এক জায়গায় ফেলে দেন কামাল উদ্দিন। এ সময় দুই শ্রমিকের সন্দেহে ধরা পড়ে যান তিনি। খণ্ডিত মরদেহ উদ্ধারের পর ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। বিচারে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়। ২০১৯ সালের ২৭ জুলাই প্রকাশ্যে গুলি করে তার মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর করা হয়।
এ ঘটনা বাহরাইনের স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন তোলে। এ নিয়ে দেশটির পার্লামেন্টে তুমুল সমালোচনা হয়। ঘটনার জেরে বাংলাদেশী ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের ফেরত পাঠানো শুরু করে দেশটি। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বন্ধ হয়ে যায় বাহরাইনে বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানি।
প্রবাসী বাংলাদেশীরা জানান, ১৯৮০ সাল থেকে বাহরাইনে সুনামের সঙ্গে চাকরি করে আসছেন ইমাম-মুয়াজ্জিনরা। ২০১৮ সালের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন মসজিদে ৩০০ জনেরও বেশি বাংলাদেশী ইমাম-মুয়াজ্জিন ছিলেন। দেশটির দুই লাখ প্রবাসী বাংলাদেশীর মধ্যে এ সংখ্যা কম হলেও মর্যাদায় তারা ছিলেন সবার ওপরে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দুজন কর্মকর্তা জানান, ফ্রি ভিসার নাম করে ট্যুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশীরা বাহরাইনে যেতে থাকলে ২০১৭ সালে বাংলাদেশীদের দেশটিতে যেতে নিরুৎসাহিত করে বিজ্ঞপ্তি দেয় দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাস। এছাড়া তখন সেখানে কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রেও সংকট ছিল। এর মধ্যেই ২০১৮ সালে ইমাম হত্যার ঘটনার পর দেশটির সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশীদের ভিসা দেয়া বন্ধ করে দেয়। এ সংকট কাটাতে পরে দূতাবাসের তরফে বেশ কয়েক দফা উদ্যোগ নিলেও সেটি সফল হয়নি।
কোভিডের সময়ও নতুন করে অনেক বাংলাদেশীকে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেয় বাহরাইন সরকার। তখন দূতাবাস নানাভাবে চেষ্টা করেও অনেক ইমাম ও মুয়াজ্জিনকে দেশটিতে রাখতে পারেনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রণালয়ের আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। দেশটির সরকারের পক্ষ থেকে কোনো চাহিদাপত্র নিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে না। তাদের চাহিদা থাকলে আমাদের জানাবে, আমরা শ্রমশক্তি রফতানি করব। তাদের চাহিদা না থাকলে ভিন্ন ঘটনা।’
চার বছর ধরে শ্রমশক্তি রফতানি বন্ধ থাকায় বাহরাইন থেকে আসা রেমিট্যান্সেও বড় প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম রেমিট্যান্স আসে বাহরাইন থেকে।
বিএমইটির তথ্য বলছে, চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে বাহরাইন থেকে ৪৫ কোটি ডলার রেমিট্যান্স আসে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫৭ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এলেও ২০২১-২২ অর্থবছরে তা ৫৬ কোটি ডলারে নেমে আসে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা আরো কমে ৫২ কোটি ডলারে দাঁড়ায়।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (কর্মসংস্থান) মীর খায়রুল আলম বলেন, ‘শ্রমশক্তি রফতানির বাজার একেক সময় একেক রকম থাকে। কোনো দেশে চাহিদা থাকতে পারে, আবার নাও থাকতে পারে। চাহিদা থাকলে তখন আমরা শ্রমিক পাঠাতে পারি। এটা সম্পূর্ণভাবে সংশ্লিষ্ট দেশের ওপর নির্ভর করে। বাহরাইনের বিষয়ে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
সূত্র: বণিক বার্তা
এ জেড কে/
Discussion about this post